ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় | ছবি: সংগৃহীত  

আবিদ হাসান: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে ছাত্রসংগঠনগুলোর আলোচনা শেষে ফেসবুকে ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে আসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি সাদিক কায়েম। ২১ সেপ্টেম্বর এই ঘটনার পর একদিন পেরোতে না পেরোতেই পরিচয় প্রকাশ পায় শিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় সাধারণ সম্পাদক এস এম ফরহাদের। দীর্ঘদিন আড়ালে থাকা এই ছাত্রসংগঠনের নেতাদের সামনে আসা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে নানা ধরনের আলোচনা। অনেকে তাদের রাজনৈতিক পরিচয় ও কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসার বিষয়টিকে যেমন ইতিবাচকভাবে দেখছেন, কেউ কেউ আবার বলছেন তাদের রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত অবস্থানগুলো সবার আগে স্পষ্ট করা দরকার।

কী ভাবছেন শিক্ষার্থীরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী (বিভাগের পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক) মাইশা মালিহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সব ক্রিয়াশীল সংগঠনের ঐকমত্যের ভিত্তিতে নিষিদ্ধ হয়েছিল শিবির। তারপর থেকে বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে শিবির সদস্যরা গোপনে কাজ করেছে, কিন্তু প্রকাশ্যে আসেনি। সম্প্রতি আরেকটি গণ-আন্দোলনের পর যেভাবে শিবির আত্মপ্রকাশ করলো, তা বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর কাছেই বিস্ময়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগঠনগুলোও স্পষ্ট ভাষায় এর প্রতিবাদ ও নিন্দা জানিয়েছে।

শিবিরের প্রকাশ্যে আসাটাকে ভালোভাবে দেখছেন উল্লেখ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের এক শিক্ষার্থী (পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, তারা আওয়ামী লীগের শাসনামলের ১৬ বছর যথেষ্ট নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে সাংগঠনিক কাজ করেছে, পড়াশোনা করছে। ওরা যদি চাঁদাবাজি করতো, কাউকে নির্যাতন করতো, তাহলে বিষয়টা ভয়ানক হতো। যতদিন শিবিরের ক্লিন ইমেজে আছে, ততদিন তাদের থাকাটাকে ভালোভাবেই দেখছি।

বিশ্ববিদ্যালয় দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মাহবুবুর রহমান সবুজ বলেন, শিবির যে আগে ছিল না, এমন না। শিবির ছিল এটা সবাই জানতো। এমনকি ছাত্রলীগের নেতারাও জানতেন। তখন তাদের রাজনৈতিক কার্যক্রম ছিল মসজিদভিত্তিক, পাঠচক্রভিত্তিক। হঠাৎ শিবিরের প্রকাশ্যে আসার বিষয়টা নিয়ে মানুষ যে আতঙ্কিত এমন না। বরং কেউ কেউ বিষয়টাকে হাস্যরসাত্মকভাবেও দেখছে।

সরকারবিরোধী আন্দোলনে শিবির সম্পৃক্ত আছে––এই তথ্য জানা থাকলে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের সম্পৃক্ত হতেন কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গত ফ্যাসিবাদী সরকার শিবিরকে সামনে আসতে দেয়নি। এই প্রেক্ষাপটে আসলে তাদের সামনে আসার সুযোগ ছিল না। ওই সরকার শিবিরকে এমন একটা গোত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে, যাদের ওপর আক্রমণ করাটাকে মনে করা হতো বৈধ। তাই আগে পরিচয় প্রকাশ করলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপরও হামলা হওয়ার শঙ্কা ছিল। সে জায়গা থেকে হয়তো শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে যেতো না।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শুরুতে সরকারবিরোধী আন্দোলন ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, শুরুতে এই আন্দোলন ছিল একটি শান্তিপূর্ণ দাবি আদায়ের আন্দোলন। যার উদ্দেশ্য ছিল চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা। সেটাকে সরকার খুব সহজভাবে সমাধান করতে পারতো। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার প্রধানসহ শীর্ষ নেতারা বেফাঁস মন্তব্য করে বিষয়টাকে সরকার পতনের আন্দোলনের দিকে নিয়ে গেছেন।

ছাত্রসংগঠনগুলো যা ভাবছে
সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের একাংশের সভাপতি সাদিকুল ইসলাম সাদিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নব্বইয়ের দশকে ক্যাম্পাসের যে রেজুলেশন, সে অনুযায়ী ছাত্রশিবির ও জাতীয় ছাত্রসমাজ নিষিদ্ধ ছিল। এবার আবার যুক্ত হলো ছাত্রলীগ। আমাদের সেই নব্বইয়ের পরিবেশ পরিষদের কথা হচ্ছে—যার ফলে তারা ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারবে না। কিন্তু এ বিষয়ে ভিসি স্যারের সঙ্গে মিটিং করার পরই তারা প্রকাশ্যে এসেছে। সে জায়গা থেকে আমরা বিষয়টির তীব্র নিন্দা জানাই। শিবিরের সঙ্গে আমাদের লড়াইটা হবে আদর্শিক। সেটি আমরা কীভাবে করবো, সেটা নিয়ে আমাদের আলোচনা চলছে।

ছাত্র ফ্রন্টের সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক বলেন, ক্যাম্পাসে ক্রিয়াশীল সংগঠনগুলোর সঙ্গে বিদ্যমান পরিবেশ পরিষদের চুক্তি ভেঙে হুট করে ছাত্রশিবিরের সঙ্গে মিটিং করাটা ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান এবং গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি। অবিলম্বে পরিবেশ পরিষদের মিটিং আহ্বান করে সন্ত্রাস-দখলদারত্বমুক্ত গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস বিনির্মাণের আহ্বান জানাচ্ছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে হলে প্রথমত বিভিন্ন সময় তাদের রাজনৈতিকভাবে বিতর্কিত অবস্থানগুলো সবার আগে স্পষ্ট করা দরকার। দ্বিতীয়ত আগামী দিনে তাদের রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কেমন হবে, সেটার ওপর নির্ভর করবে শিক্ষার্থীরা এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠন তাদের কীভাবে নেবে। তবে এটা বলতে পারি, আমরা সব প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক সংগঠন এবং ব্যক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাসের জন্য কার্যক্রম অব্যাহত রাখবো।

শিবির বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আছে জানলে সঙ্গে থাকতেন কিনা––এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরও বলেন, আন্দোলনের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, যে দাবিতে আন্দোলন হচ্ছে তা ন্যায্য কিনা। প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং তারই ধারাবাহিকতায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের দাবিতে যে আন্দোলন হয়, তা সম্পূর্ণ ন্যায্য এবং গণতান্ত্রিক আন্দোলন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ যেহেতু একটি রাজনৈতিক জোট নয়, কমন প্ল্যাটফর্ম, বিভিন্ন চিন্তার মানুষ এই প্ল্যাটফর্মে ছিল। তবে তারা কেউই কোনও রাজনৈতিক চিন্তার সম্মিলিত প্রতিনিধি হিসেবে ছিল না, ছিল ব্যক্তি হিসেবে। এর অংশ হিসেবেই আমরা সবাই এই আন্দোলনে ছিলাম। বিষয়টাকে এভাবেই দেখতে হবে বলে মনে করি।

বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের একাংশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি মেঘমল্লার বসু বলেন, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের সময় থেকে ছাত্রশিবির ও জাতীয় ছাত্রসমাজ নিষিদ্ধ ছিল। শিবির নিষিদ্ধ থাকায় কিন্তু তাদেরই লাভ হয়েছে। কারণ তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যার ফলে আমরা জানতে পারতাম না আসলে কারা শিবির করছে। তাদের সঙ্গে আমাদের আদর্শিক লড়াই, সে লড়াই তাদের সঙ্গে করতে হলে আমাদের তাদের চিনতে হবে। সে জায়গা থেকে তাদের প্রকাশ্যে আসাটাকে আমরা ইতিবাচক হিসেবে দেখছি।

ঢাবি শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামাম শিপন বলেন, বাংলাদেশে একাত্তর পরবর্তী তিনটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত গণভ্যুত্থানের চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে পরবর্তী সময় নির্ধারিত হয়েছে। এখন চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কারা রাজনীতি করবে বা করবে না, সেই সিদ্ধান্ত নেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজন। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে চলমান সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগ ছাত্ররাজনীতির নামে যে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছে, তাতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে একটা নেতিবাচক ধারণা জন্ম নিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আমরা মনে করি মেধা ও জ্ঞানের ভিত্তিতে একটা ইতিবাচক রাজনীতি শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরাটা এই মুহূর্তে জরুরি। ছাত্ররাজনীতি কে করবে বা করবে না এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আমরা কেউ না। ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের পক্ষে থাকা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজন এই বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেবে।