তালেবানের নতুন আইন নিয়ে কিশোরী বললেন, ‘যদি কথা বলতে না পারি, বাঁচব কেন’

আপাদমস্তক পর্দায় ঢাকা আফগান নারী | ফাইল ছবি: রয়টার্স

পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: শাবানার (ছদ্মনাম) প্রাত্যহিক জীবনের সবচেয়ে আকর্ষণীয় কাজ প্রতিদিন ইংরেজি শিখতে যাওয়া। রাজধানী কাবুল থেকে বন্ধুদের সঙ্গে বাসে করে একটি প্রাইভেট কোর্স করতে যায় সে। বন্ধুদের সঙ্গে গল্প করতে করতে আর হাসতে হাসতে, প্রতিদিন এক ঘণ্টা নতুন কিছু শেখে। তালেবান আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করার পর শাবানার জীবনে যে শূন্যতা গ্রাস করেছে, ইংরেজি শিখতে যাওয়া কিছু সময়ের জন্য তা থেকে তাঁকে মুক্তি এনে দেয়।

অন্য কোনো দেশে থাকলে শাবানা হয়তো আগামী বছর উচ্চমাধ্যমিক পাস করত, ব্যবসা প্রশাসনে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের যে স্বপ্ন দেখে, সে পথে আরেকটু অগ্রসর হতে পারত।

আফগানিস্তানে শাবানা এবং তার মতো অন্য সব কিশোরী গত তিন বছর ধরে সাধারণ শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশটিতে মাধ্যমিক স্কুলে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বাইরে বের হলে আমরা ভয়ে থাকি। যখন বাসে উঠি, ভয়ে থাকি। আমরা মুখ থেকে মাস্ক নামানোর সাহস পর্যন্ত দেখাই না। আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাও এড়িয়ে চলি, মনে হয় তালেবানের কেউ কথা শুনে ফেললে আমাদের আটকাবে ও প্রশ্ন করবে।

এমনকি জীবনযাপনের ছোট ছোট আনন্দের মুহূর্তও এখন অনেকের কাছে ভয়ে ভরা। আফগানিস্তানে একটি নতুন আইন জারি করা হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে, যদি কোনো নারী নিজের বাড়ির বাইরে যান, তিনি উচ্চ স্বরে কথা বলতে পারবেন না।

শাবানা বলে, ‘বাইরে বের হলে আমরা ভয়ে থাকি। যখন বাসে উঠি, ভয়ে থাকি। আমরা মুখ থেকে মাস্ক নামানোর সাহস পর্যন্ত দেখাই না। আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তাও এড়িয়ে চলি, মনে হয় তালেবানের কেউ কথা শুনে ফেললে আমাদের আটকাবে ও প্রশ্ন করবে।’  

আফগানিস্তানে বিবিসি সে দেশে জারি হওয়া নতুন আইন নিয়ে কয়েকজন আফগান কিশোরী ও নারীর সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়েছে। কথা বলেছে তালেবান মুখপাত্রের সঙ্গেও। তালেবানের সর্বোচ্চ নেতা হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদা নতুন এ আইন জারি করেছেন।

নতুন আইনে আফগানিস্তানের অনৈতিকতা প্রতিরোধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও নীতি–পুলিশকে কঠোরভাবে নাগরিকদের আচরণবিধি পালনে বাধ্য করতে ব্যাপক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

নানা বিধিনিষেধ জারি করে আফগান নারীদের স্বাধীনতা আগে থেকেই হরণ করা হয়েছে। নতুন আইন তাঁদের জন্য আরেকটি বড় ধাক্কা।

শাবানা বলে, ‘যদি আমরা কথা বলতে না পারি, তবে কেন বাঁচব? আমরা অনেকটা বেঁচে থেকেও মৃত মানুষের মতো। আমি যখন নতুন আইন সম্পর্কে জানতে পারি, তখন ওই ইংরেজি শেখার কোর্সে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কারণ যদি আমি বাইরে যাই, আমাকে কথা বলা বন্ধ রাখতে হবে এবং তারপর খারাপ কিছু ঘটতে পারে। হয়তো আমি নিরাপদে বাড়ি ফিরতে পারব না। কিন্তু আমার মা আমাকে ইংরেজি শেখা চালিয়ে যেতে সাহস দিয়েছেন।’

তিন বছর আগে পশ্চিমা–সমর্থিত আশরাফ গনি সরকারকে হটিয়ে আফগানিস্তানের শাসনক্ষমতায় আসে তালেবান। তখনই এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, যদি আইনের কঠোর বাস্তবায়নের উদ্যোগ না–ও নেওয়া হয়, লোকজন ভয়ে নিজে থেকেই আইন পালন করতে শুরু করবেন।

রাজধানী কাবুলের মতো শহরগুলোতে সড়কে এখনো অল্পসংখ্যক নারীদের দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁদের প্রায় সবাই কালো অথবা গাঢ় নীল রঙের মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা ঢিলেঢালা পোশাক বোরকা পরে থাকেন। তাঁদের বেশির ভাগের পুরো মুখমণ্ডল ঢাকা থাকে, শুধু চোখ দেখা যায়। গত বছর জারি করা একটি ফরমানের প্রভাব এটা।

নওশীন (ছদ্মনাম) নামের একজন আফগান আন্দোলনকর্মী নতুন আইনের প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘সব সময় মনে হবে, আপনি কারাগারে আছেন। এখানে এমনকি নিশ্বাস নেওয়াও কঠিন হয়ে গেছে।’

গত বছর পর্যন্তও আফগান নারীদের ছোট যে দলটি কাবুল ও অন্যান্য শহরে নিজেদের অধিকারের দাবিতে সড়কে মিছিল করেছেন, নওশীন তাঁদের একজন। তালেবান সরকার কঠোর হস্তে ওই সব বিক্ষোভ দমন করেছে।

নওশীন গত বছর আটক হয়েছিলেন। সে ঘটনা স্মরণ করে কান্নায় ভেঙে পড়ে তিনি বলেন, ‘তালেবান সদস্যরা আমাকে টেনেহিঁচড়ে একটি গাড়িতে তুলে বলেন “কেন আপনি আমাদের বিরুদ্ধে কাজ করছেন?” তাঁরা আমাকে একটি অন্ধকার, ভয়ংকর জায়গায় নিয়ে যান ও আটকে রাখেন। আমার বিরুদ্ধে তাঁরা আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করেন। করেন মারধরও। বন্দিদশা থেকে আমাদের যখন মুক্তি দেওয়া হয়, আমরা আর আগের মানুষ ছিলাম না। এ কারণেই আমরা বিক্ষোভ করা বন্ধ করে দিয়েছি। এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়া ভালো।’  

এখন আফগান নারীরা অনলাইনে নিজেদের স্বাধীনতার গান গাওয়ার ভিডিও পোস্ট করে প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। তাঁদের মুখ ঢাকা থাকে। এমনই একটি গানের লাইন, ‘আসুন, সমস্বরে আওয়াজ তুলি, আসুন, হাতে হাত রেখে একসঙ্গে চলি এবং এ নিষ্ঠুরতা থেকে মুক্ত হই।’

জানতে চাইলে তালেবানের একজন মুখপাত্র বিবিসিকে বলেন, শরিয়াহ আইন মেনে নতুন এই আদেশ জারি করা হয়েছে।

তালেবান সরকারের উপমুখপাত্র হামদুল্লাহ ফিতরাতের সঙ্গে কথা বলেছেন বিবিসির দক্ষিণ এশিয়া ও আফগানিস্তানের প্রতিনিধি যোগিতা লিমায়ে। যোগিতা একজন নারী হওয়ায় তাঁর সঙ্গে ছবি তুলতে রাজি হননি হামদুল্লাহ। এমনকি তাঁর সঙ্গে মুখোমুখি বসেও কথা বলেননি।

নতুন আদেশের পক্ষে হামদুল্লাহ বলেন, ‘শরিয়াহ অনুযায়ী সর্বোচ্চ নেতা নতুন আইনের অনুমোদন দিয়েছেন। যেকোনো আলেম শরিয়াহ আইনের সঙ্গে নতুন আইনের বৈপরীত্য আছে কি না, যাচাই করে দেখতে পারেন।’

পেশায় শিক্ষক শিরিন (ছদ্মনাম) তালেবান মুখপাত্রের সঙ্গে একমত হননি। তিনি বলেন, ‘শরিয়াহ নিয়ে এটা তাঁদের নিজস্ব ব্যাখ্যা। ইসলাম নারী ও পুরুষ উভয়কেই এ অধিকার দিয়েছে যে তাঁরা তাঁদের শিক্ষা ও অগ্রগতির বেছে নিতে পারেন। যদি তাঁরা (তালেবান) বলেন, নারীদের কণ্ঠস্বর শোনা যাওয়া উচিত নয়, তবে ইতিহাসে ফিরে চলুন। ইসলামের ইতিহাসে এমন অনেক নারী ছিলেন, যাঁরা অধিকারের পক্ষে উচ্চ কণ্ঠে কথা বলেছেন।’    

নারীশিক্ষার ওপর জারি করা নিষেধাজ্ঞার নীরব প্রতিবাদ হিসেবে আফগান নারীদের একটি দল গোপনে স্কুল কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। শিরিন এ নেটওয়ার্কের অংশ। বড় ঝুঁকি মাথায় নিয়ে এ স্কুল কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য মাঝেমধ্যেই স্কুলের জায়গা পরিবর্তন করতে হয় তাঁদের।

নতুন আইন শিরিনের ভয় আরও বাড়িয়েছে।

শিরিন বলেন, ‘প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি আল্লাহর কাছে দিনটি নিরাপদে কেটে যাওয়ার প্রার্থনা করি। যখন নতুন আইন জারি হলো, আমি আমার শিক্ষার্থীদের কাছে সেটির সব নিয়ম ব্যাখ্যা করি এবং তাদের বলি, সব আরও কঠিন হতে চলেছে। কিন্তু এসব নিয়ে আমি এখন খুবই ক্লান্ত। মাঝেমধ্যে আমার শুধু চিৎকার করতে ইচ্ছা করে।’

বিবিসি হামদুল্লাহকে প্রশ্ন করেছিল, দেশের নারী ও মেয়েদের প্রতি তালেবান সরকারের কী দায়িত্ব রয়েছে। শিক্ষা গ্রহণের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে অনেক নারী বিষণ্নতায় ডুবছেন ও আত্মহত্যার কথা ভাবছেন।

জবাবে মুখপাত্র বলেন, ‘আমাদের বোনদের শিক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের অনেক বোনদেরই দাবি এটি। আমরা এ ইস্যু সমাধানের চেষ্টা করছি। আমরা আমাদের নেতাদের কাছ থেকে একটি সিদ্ধান্ত আসার অপেক্ষায় আছি। যখন সিদ্ধান্ত হবে, সবাই এটা নিয়ে বলতে পারব।’