আওয়ামী লীগ

এমরান হোসাইন শেখ: নানাভাবে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ। পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয় নেওয়ার পর তার দল আওয়ামী লীগ মাঠের রাজনীতিতে একেবারে নীরব হয়ে গেলেও সরব হয়ে উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। দলটির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজের পাশাপাশি টেলিগ্রাম চ্যানেল, এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউবে প্রতিনিয়ত তথ্যমূলক ভিডিও আপলোড করা হচ্ছে। পাশাপাশি ভিনদেশীয় একটি নম্বর থেকে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খুলে সেখান থেকেও আপডেট জানানো হচ্ছে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করে ভারতে চলে যান। বর্তমানে তিনি সেখানেই অবস্থান করছেন। দলীয় প্রধানের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরপরই মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্য ও দলের সক্রিয় অধিকাংশ নেতাকর্মী আত্মগোপনে চলে যান। অবশ্য পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পরে স্থলপথে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে প্রতিবেশী দেশ ভারতে চলে গেছেন। কেউ কেউ আকাশপথেও বিদেশ যেতে সক্ষম হয়েছেন। দেশে অবস্থানকারীদের মধ্যে গত দেড় মাসে বেশ কয়েকজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। অন্যরা এখনও দেশেই বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপনে রয়েছেন।
 
সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়, নেতাকর্মীদের বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় আওয়ামী সমর্থিত কয়েকজন ‘গণপিটুনিতে’ হত্যার শিকারও হয়েছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এদিকে ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ১৩ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকার আদালতে প্রথম হত্যা মামলা করা হয়। এরপর গত দেড় মাসে তার বিরুদ্ধে দেড় শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর সিংহভাগই হত্যা মামলা। শেখ হাসিনা ছাড়াও সব মামলায় আওয়ামী লীগ ও সাবেক সরকারের প্রভাবশালী এমপি-মন্ত্রীদের আসামি করা হয়েছে। এখনও নতুন নতুন মামলা দায়ের চলমান রয়েছে।
 
এছাড়া সরকার পতনের পর পর কয়েক দিন শেখ হাসিনার যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের ভিডিও বার্তা এবং বিদেশি গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মায়ের ‘পদত্যাগ’, সাবেক সরকার ও আওয়ামী লীগ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কথা বলেন। তবে তার ‘স্ববিরোধী’ নানা বক্তব্যে নানা বিভ্রান্তি তৈরি হয়। অবশ্য পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে জয় এখন কোনও কথা বলছেন না। 

শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর রাজধানীসহ সারা দেশে টানা ১৬ বছর দেশ শাসন করা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা একেবারেই নিশ্চুপ হয়ে যায়। অবশ্য ব্যতিক্রম হিসেবে শেখ হাসিনার জন্মস্থান ও নির্বাচনি এলাকায় গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ থেকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। ঢাকায় ১৫ আগস্টের কর্মসূচি পালন করতে দেওয়া না হলেও গোপালগঞ্জ আওয়ামী লীগ দিনটি পালন করে। পরে অবশ্য সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের জের ধরে বর্তমানে গোপালগঞ্জেও কোনও কর্মসূচি পালন করতে দেখা যাচ্ছে না।
 
মাঠের রাজনীতি থেকে ‘উধাও‘ হয়ে গেলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ সক্রিয় রয়েছে আওয়ামী লীগ। সম্প্রতি দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে একটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ফেসবুক পেজ (https://www.facebook.com/awamileague.1949) এক্স (টুইটার) অ্যাকাউন্ট (https://twitter.com/albd1971); টেলিগ্রাম চ্যানেল (https://t.me/albd1949) এবং ইউটিউব চ্যানেলের (https://www.youtube.com/@myalbd) লিংক শেয়ার করে জানানো হয়, এসব সামাজিক মাধ্যমে এখন থেকে নিয়মিত তথ্য আপডেট দেওয়া হবে।
 
পাশাপাশি একটি বিদেশি নম্বরকে (+1(917)5699327) দলের অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট উল্লেখ করে সেখানে দলীয় সব খবর এবং তথ্য পাঠাতে অনুরোধ করে দলের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে নোটিশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের ওই অফিসিয়াল মাধ্যমের বাইরে আওয়ামী লীগের প্যাডে বা অন্য কোনও মাধ্যমে বক্তব্য-বিবৃতি এলে তাতে বিভ্রান্ত না হওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

ভেরিফায়েড ফেসবুকসহ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গত কয়েকদিনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিনিয়তই এসব মাধ্যমে পোস্ট, ফটোকার্ড, ভিডিও, বার্তা আপলোড দেওয়া হচ্ছে। এতে দলের নেতাকর্মী ও গণমাধ্যমকে উদ্দেশ করে নানা নির্দেশনা ও বার্তা দেওয়ার পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা, অগ্নিকাণ্ড, ভাঙচুরের আপডেট দেওয়া হচ্ছে। গণমাধ্যমে প্রকাশিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতিবাচক এবং আওয়ামী লীগের ইতিবাচক নানা খবরও শেয়ার করা হচ্ছে।
 
এছাড়া নিজস্ব ব্যবস্থাপনা কিংবা অন্য সোর্সে পাওয়া নানা ভিডিওচিত্র আপলোড করা হচ্ছে। সম্প্রতি ফেসবুক পেজ থেকে দলের নেতাকর্মীদের হয়রানি, বাড়িঘর ভাঙচুরের বিষয়ে থানায় অভিযোগ দায়ের বা জিডি করা এবং সেনাক্যাম্পে গিয়ে অভিযোগ দায়েরের পরামর্শ দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কোনও ‘অপপ্রচার’ হলে বা দলের নামে বা প্যাডে কোনও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার হলেও সেটারও ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে এসব মাধ্যম থেকে।
 
আওয়ামী  লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা নিজেও হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে দেশে-বিদেশে দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের ফোন করে নানা পরামর্শ ও নির্দেশনা দিচ্ছেন। তিনি ভারতে যাওয়ার সপ্তাহখানেকের মধ্যে দেশে বিভিন্নজনকে ফোন দিয়ে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের আহ্বান জানান। তিনি এখনও এটি অব্যাহত রেখেছেন বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
 
অবশ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একাধিক কথোপকথন ফাঁস হওয়া এবং এর সূত্র ধরে বরগুনা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের গ্রেফতার হওয়ার প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনা সতর্কতার সঙ্গে কথা বলছেন; এমন একাধিক নেতা নিশ্চিত করেছেন। তারা বলেছেন, শেখ হাসিনা এখন বাংলাদেশে অবস্থানকারী নেতাকর্মীদের সঙ্গে খুব কমই কথা বলছেন। বিদেশে দলের যেসব নেতাকর্মী রয়েছেন তাদের সঙ্গে কম-বেশি যোগাযোগ করে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন।

আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে প্রকাশ্যে একেবারেও নীরব হলেও বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজপথে রয়েছে; এমন ব্যক্তি-গোষ্ঠীকে নানাভাবে সমর্থন দিচ্ছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন। এসব থেকে তাদের নানা ধরনের পরামর্শ ছাড়াও দলের মুখ না চেনা কর্মীদের এসব কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে উৎসাহ দিচ্ছে। এছাড়া দলীয় প্রধানের নির্দেশনা অনুসরণ করে তারা বিদেশে সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছে।
 
অবশ্য দেশে না পারলেও প্রবাসে দলটির নেতাকর্মীরা সক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন। অংশ নিচ্ছেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে। গত ৯ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সামনে প্রবাসী আওয়ামী লীগের উদ্যোগে প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এর আগে ২১ আগস্ট দেশটিতে প্রতিবাদ করেছে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। ‘আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে‘— দাবি করে ওইদিন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারকে স্মারকলিপিও দেয় বলে জানা গেছে।

গত ২৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে দলটির নেতাকর্মীর নিরাপত্তায় হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে স্মারকলিপি দিয়েছে। তার আগে প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। ‘অসাংবিধানিক অনির্বাচিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গত ৫ আগস্ট থেকে সারা দেশে সহিংসতা দমনে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়ার অভিযোগে‘ ওয়াশিংটন ডিসিতে হোয়াইট হাউজ ও স্টেট ডিপার্টমেন্টের সামনে সমাবেশ করা হয়েছে। পরে যে স্মারকলিপি দেওয়া হয় তাতে ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করা’র প্রসঙ্গটিও উল্লেখ করা হয়েছে।
 
গত ১৪ সেপ্টেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের প্রতিবাদে সমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র আওয়ামী লীগ ড. ইউনূসের যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছানোর দিন ও জাতিসংঘ অধিবেশনে ভাষণের দিন প্রতিবাদ সমাবেশ করবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে।