অরুণাচলে ভারত-চীন সীমান্ত, যা ম্যাকমোহন লাইন নামে পরিচিত

রঞ্জন বসু, দিল্লি: চীনের সেনাবাহিনী পিএলএ’র সদস্যরা অরুণাচল সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করে ৬০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে— দিনকয়েক আগে প্রকাশিত এমন একটি খবর ঘিরে দেশে ও দেশের বাইরে ব্যাপক চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারিভাবে প্রায় দু’দিন ভারত এই খবরটি নিয়ে নীরব ছিল। ফলে এই বিষয়টি নিয়ে জল্পনা আরও বেড়ে যায়।

পরে অবশ্য সরকারের একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ভারতের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছেন, তবে তাতেও তর্ক-বিতর্ক মোটেও কমেনি।

কিন্তু বাস্তবেও কি তা-ই ঘটেছে? চীনা সৈন্যরা ভারতের ভেতরে ঢুকে থাকলে কতদূর এসেছে বা কী ধরনের কাজকর্ম করেছে? বাংলা ট্রিবিউনের পক্ষ থেকে গোটা বিষয়টি নিয়ে বিশদে অনুসন্ধান চালানো হয়েছে। তারই ফলাফল এই প্রতিবেদনে তুলে ধরা হলো।

প্রথম খবরটি কীভাবে জানা গেলো?

এই খবরটি প্রথম প্রকাশিত হয় ‘নিউজফাই’ (নিউজ ফর ইউ) নামে অরুণাচল প্রদেশের একটি পোর্টালে। ওই পোর্টালের সাংবাদিক ইরানি সোনোওয়াল লেপচা গত ৬ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত তার এক রিপোর্টে দাবি করেন, রাজ্যের আনজাও জেলার সীমান্তবর্তী কাপাপু এলাকায় চীনা সৈন্যরা নাকি ভারতের ৬০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং তারা সেখানে ‘ক্যাম্প’ করেও অবস্থান করছিল। 

পাথরের ওপর স্প্রে পেইন্ট করে লেখা | ছবি: নিউজফাই

এই দাবির সপক্ষে তিনি কিছু ছবিও তুলে ধরেন। যেগুলোতে দেখা যায়—পার্বত্য ওই এলাকায় পাথরের ওপর স্প্রে পেইন্টিং করে চীনা ভাষায় কিছু লেখা রয়েছে এবং সঙ্গে ‘চায়না’ শব্দটা ও চলতি সালটাও (২০২৪) ইংরেজিতে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্য একটি ছবিতে দেখা যায়—সেখানে আগুন জ্বালিয়ে বনভোজন করা হয়েছে এবং বিভিন্ন চীনা খাবারের উচ্ছিষ্ট আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে।

সীমান্তের ওই জনবিরল এলাকার কিছু বাসিন্দা ওই পাথরের আর পিকনিকের পরের ছবি তুলে নিজেদের সোশ্যাল মিডিয়াতে পোস্ট করেছিলেন। সেখানে থেকেই নিউজফাই ওই ছবিগুলো পিক করে এবং নিজেদের সূত্রকে উদ্ধৃত করে জানায় যে ওই রিপোর্ট প্রকাশের সপ্তাহখানেক আগে (অর্থাৎ আগস্টের একেবারে শেষ দিকে) এই ‘আগ্রাসনে’র ঘটনা ঘটেছিল।

তারা আরও দাবি করে, ইন্দো-টিবেটান বর্ডার পুলিশ (আইটিবিপি) নামে যে বাহিনী ভারত-চীন সীমান্ত পাহারা দিয়ে থাকে, হাডিগ্রা গিরিপথের কাছে তাদের শেষ ক্যাম্পটি অবস্থিত কাপাপুতেই—যে এলাকায় চীনা সৈন্যরা ঢুকে পড়েছিল বলে বলা হচ্ছে। আর চাগলাগাম হলো আনজাও জেলার নিকটতম প্রশাসনিক সার্কেল, যা ভারত-চীন সীমান্ত (ম্যাকমোহন লাইন) থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে।

কেন এই রিপোর্ট নিয়ে বিতর্ক?
গত কয়েক বছরে ভারত-চীন সীমান্তের বিভিন্ন জায়গায় চীনা সৈন্যরা জোর করে ঢুকে পড়েছে, নানা ধরনের স্থাপনা তৈরি করছে বা সেনাঘাঁটি পর্যন্ত তৈরি করেছে–এ জাতীয় নানা খবর দেশ-বিদেশের মিডিয়াতে প্রকাশিত হয়েছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে স্যাটেলাইট থেকে তোলা ছবিতেও এর প্রমাণ মিলেছে। আর চীনারা কোথাও একবার ঢুকলে সেটা যদি ছেড়েও যায়, তার আগে নিজের দেশের নাম বা বাহিনীর প্রতীক সেখানে রেখে দিয়ে যায়। কারণ, এটা তাদের প্রোপাগান্ডার অংশ। কাপাপুতে এই ঘটনাতেও সেরকমটাই হয়েছিল বলে ধারণা করা হচ্ছে।

সৈন্যদের বনভোজনের পর ফেলে যাওয়া অবশেষ | ছবি: নিউজফাই

তবে এর আগে এরকম কোনও ঘটনাতেই চীনা সৈন্যরা ভারতের ৬০ কিলোমিটার অভ্যন্তরে প্রবেশ করেছে বলে দাবি করা হয়নি—এটা বড়জোর কয়েকশ’ মিটার বা এক-দুই কিলোমিটারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। কাজেই নিউজফাই’র ওই রিপোর্ট নিয়ে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হতে দেরি হয়নি সঙ্গত কারণেই।

অরুণাচলের প্রথম সারির ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য অরুণাচল টাইমস’ গত ৮ সেপ্টেম্বর (অর্থাৎ মূল রিপোর্ট প্রকাশের দুদিন পরে) জানায়, তারা ওই খবরের সত্যাসত্য জানতে আসামের তেজপুরে সেনাবাহিনীর পিআরও বা জনসংযোগ কর্মকর্তার সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু তার কাছ থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। সেনাবাহিনী প্রথমে এই বিষয়টি নিয়ে নীরব থাকায় যথারীতি এটি নিয়ে জল্পনা বাড়তে থাকে।

দ্য অরুণাচল টাইমসে সেনার নীরবতা নিয়ে প্রকাশিত রিপোর্ট

ভারত সরকারের প্রতিক্রিয়া   
এরপর গত ৯ সেপ্টেম্বর রিপোর্ট প্রকাশের তিন দিন পরে, ভারত সরকার এই বিষয়টি নিয়ে প্রথম মুখ খোলে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কিরেন রিজিজু, যিনি নিজে অরুণাচল প্রদেশের এমপি ও শীর্ষস্থানীয় একজন বিজেপি নেতা, তিনি দাবি করেন যে ‘চীনা সৈন্য ভারতের ভেতরে ঢুকে পড়ার দাবিটি আদৌ সত্য নয়।’

তার বক্তব্য ছিল, যেহেতু চীন ও ভারতের মধ্যকার সীমান্ত (যাকে এলএসি বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণরেখা বলেও ডাকা হয়) অনেক জায়গাতেই সুস্পষ্টভাবে নির্ধারিত বা চিহ্নিত নয়, তাই এরকম বিতর্কিত এলাকাগুলোতে দুপক্ষের সৈন্যরাই পালা করে টহল দিয়ে থাকে। ফলে সীমান্তে এরকম অনেক জায়গা আছে, যেখানে ভারত ও চীন—দুই দেশের সেনাদেরই নিয়মিত পা পড়ে। এ ধরনের কোনও একটা জায়গায় চীনা সৈন্যদের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেলেও সেটাকে ভারতীয় ভূখণ্ডের ‘এনক্রোচমেন্ট’ (অবৈধ দখলদারি) বলা চলে না, দাবি করেন কিরেন রিজিজু।

কিরেন রিজিজু | ফাইল ছবি

তিনি বার্তা সংস্থা পিটিআইকে আরও বলেন, ‘অনির্ধারিত এলাকায় কেউ ঢুকে যদি পাথরের ওপর নিজের দেশের নাম লিখে যায়, তাহলেই কি সেটা তাদের ভূখণ্ড হয়ে যায়?’ তবে এই ঘটনাটা সীমান্তে ভারতের দিকে বা কতটা ভেতরে ঘটে থাকতে পারে, সে ব্যাপারে তিনি কিছু বলেননি।

তাহলে আসল ঘটনাটা কী?
ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর জেনারেল ও অধুনা নিরাপত্তা বিশ্লেষক দীপঙ্কর ব্যানার্জি দীর্ঘদিন অরুণাচলের চীন সীমান্তে ভারতীয় সেনা কমান্ডার হিসেবে কর্মরত ছিলেন, পুরো এলাকাটাকে তিনি চেনেন হাতের তালুর মতো।  

দীপঙ্কর ব্যানার্জি বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন, ‘প্রায় সাড়ে তিন হাজার দীর্ঘ ভারত-চীন সীমান্তের ১১২৬ কিলোমিটারই অরুণাচলের সঙ্গে, যার সিংহভাগই আবার ‘বিতর্কিত’ বা ‘অনির্ধারিত’। অর্থাৎ এই সীমান্তের বহু জায়গাতেই দুই দেশ এখনও একমত হতে পারেনি যে সীমান্তরেখাটা ঠিক কোথা দিয়ে টানা হবে। এই বিতর্কিত এলাকায় কোথাও রয়েছে গিরিখাত, কোথাও সুউচ্চ পাহাড় বা উপত্যকা।’

তিনি জানান, দুই দেশের সীমান্তরক্ষীরাই এই বিতর্কিত এলাকাগুলোতে টহল দেয়, তবে সেটা কখনোই একসঙ্গে নয়। স্থানীয় স্তরে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে কখনও ভারতীয়রা, কখনও বা চীনারা সেখানে টহল দেয়। তবে কারোরই সেখানে স্থায়ী কোনও স্থাপনা তৈরির বা এমনকি তাঁবু খাটানোরও অনুমতি নেই। 

সাবেক মেজর জেনারেল ও অধুনা নিরাপত্তা বিশ্লেষক দীপঙ্কর ব্যানার্জি | ফাইল ছবি

 দীপঙ্কর ব্যানার্জির কথায়, ‘যেহেতু অরুণাচলকে চীনারা নিজেদের এলাকা বলে দীর্ঘদিন ধরেই দাবি করে আসছে, তাই চীনা সৈন্যরা ওই এলাকায় টহল দিতে এলে মাঝে মাঝেই নানা রকম ‘দুষ্টুমি’ করে যায়। এই হয়তো পাথরের ওপর চীনের নাম লিখে গেলো বা ভারতকে কোনও গালিগালাজ করে গেলো– আমরা এগুলো আগেও অনেক দেখেছি। এগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দরকার আছে বলে মনে করি না।’

তবে সীমান্তের এই বিতর্কিত এলাকাগুলো কোথায়ও ২-৪ কিলোমিটারের বেশি চওড়া নয়। সামান্য দু-একটি জায়গায় হয়তো একটি উপত্যকা নিয়ে বিরোধ, সেটা হয়তো বড়জোর ৮-১০ কিলোমিটার প্রশস্ত, তার বেশি কখনোই নয়। ফলে চীনা সৈন্যরা এরকম একটি বিতর্কিত জায়গায় গোপনে ৬০ কিলোমিটার ভেতরে ঢুকে পড়েছে এবং ভারতীয় বাহিনী কিছুই টের পায়নি— এটা কার্যত ‘অসম্ভব’ বলেই দীপঙ্কর ব্যানার্জির দৃঢ় ধারণা।

‘একটা দেশের অভ্যন্তরে ৬০ কিলোমিটার ঢুকে পড়া মানে তো যুদ্ধ ঘোষণার শামিল। চীন বা তাদের পিএলএ’র কাছ থেকে কি আমরা এমন কোনও বার্তা পেয়েছি যে তারা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছে? পাইনি! কাজেই একটা ছোটখাটো দুষ্টুমিকে অত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই’, বলছিলেন তিনি।