সাদিয়া আফরিন

পাহাড় যাদের টানে তারা জানেন পথ যত কঠিন ততটাই বেশি সুন্দর শেষটা। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্তি এলেও তারা থেমে দুদণ্ড শান্তি নিয়ে আবার হাঁটা শুরু করেন। কারণ এই হেঁটে যাওয়ার মাঝেই আনন্দ। পাহাড়কে ভালোবেসেই ট্রেকিংকে ভালোবাসা। যারা ট্রেকিং পছন্দ করেন তাদের প্রায় সবার বাকেট লিস্টে একটি স্থান থাকেই, সেটি অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প।

আজকে অন্নপূর্ণা বেসক্যাম্প নিয়ে আমার নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। যারা প্ল্যান করছেন অনেকদিন ধরে, তারা এবার গুছিয়ে নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন।

যাওয়ার আগে কী করবেন 

● ট্রেকিং উপযোগী জুতো
যে জুতোটা পরে আপনি পার্টিতে যান সেটা তো ট্রেকিং এ পরা যাবেই না, এমনকি যে জুতো পরে অফিসে আসেন বা সকালে হাঁটতে বের হয়ে থাকেন সেটিও পরা যাবে না ট্রেকিং এ যাওয়ার সময়। ভালো গ্রিপ আছে এমন হালকা ওজনের জুতো পরুন। পাশাপাশি জুতোটা যেন দ্রুত শুকিয়ে যায় সে দিকেও খেয়াল রাখুন। এজন্য পানিতে ভিজলে ওজন বেড়ে যায় এধরণের কাপড়ের জুতো এড়িয়ে চলুন।

● সঙ্গে রাখুন পানি
ট্রেকিং এ আপনি সারাক্ষণই ঘামছেন। তাই শরীরের প্রয়োজন পানি। আপনার সাথে পানির একটি বোতল রাখুন। একটু পর পর পানি পান করুন। তবে কখনোই একবারে অনেক পানি পান করবেন না। তাহলে আপনি আরও দুর্বল হয়ে যাবেন, আপনার বসে পড়তে ইচ্ছে করবে। সামান্য পানি বার বার পান করুন।

● স্যালাইন বা গ্লুকোজ
পানি তো সাথে রাখবেনই এর সাথে যোগ করুন স্যালাইন বা গ্লুকোজ। সম্ভব হলে দু'টোই সাথে রাখুন। ট্রেকিং এর পথ চেনা পরিচিত হলে অর্থাৎ ঐ পথে আগেও অনেকেই গিয়ে থাকলে তাদের কাছ থেকে পানির উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে নিন। স্যালাইন অবশ্যই পানিতে মিশিয়ে খাবেন। তবে গ্লুকোজ না মিশিয়ে খেলেও কাজ করবে। মিশিয়ে খেলে বেশি কাজ করবে। ট্রেকিং এ শরীর পানির অভাব বোধ করে ভীষণ। কিন্তু শুধু পানি শক্তি দেবে না। তাই অবশ্যই ট্রেকিং এর ব্যাগ গোছানোর সময়ই ব্যাগে স্যালাইন এবং গ্লুকোজ নিন।

● উপযুক্ত ব্যাগ
ট্রেকিং এ যাচ্ছেন অথচ ব্যাগ নিলেন বাজারের! হবে তাহলে? আমি শপিং ব্যাগ নিয়েও ট্রেকিং এ আসতে দেখেছি অনেককে। এর চেয়ে বোকামি আর হয় না। আবার সব ব্যাগপ্যাকই ট্রেকিং এর জন্য উপযুক্ত হয় না। অনেক ব্যাগ আছে যাতে অল্প জিনিস নিলেও ভারি হয়ে যায়। এটা হয় ব্যাগের বেল্ট সিস্টেমের কারণে। যেসব ব্যাগে কাঁধের পাশাপাশি কোমরেও বন্ধনী থাকে সেসব ব্যাগে অনেক জিনিস নিলেও শরীরের উপর চাপ কম পড়ে।

প্রয়োজনীয় জিনিসের বাইরে কিছু নয়
পাহাড়ে ট্রেকিং আমাদের সমতলের মানুষদের জন্য খুব কঠিন একটা কাজ। পাহাড়ি মানুষ হলে যেই পথ খুব দ্রুত পাড়ি দেবে সেই পথই আমাদের পাড়ি দিতে যাবে অনেকটা শ্রম এবং সময়। তাই ব্যাগ গোছানোর সময় অবশ্যই শুধু দরকারি জিনিস নিন। অযথা ব্যাগ ভারি করে কষ্ট বাড়াবেন না। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বহন করার আরেকটি সমস্যা হল, প্রয়োজনীয় জিনিসটি বাদ পড়ে যাওয়া। আপনি সখের সানগ্লাস একটির বদলে ৩টি নিলেন আর সানস্ক্রিন নিতে ভুলে গেলেন। এই সমস্যা এড়াতে ট্রেকিং এ ব্যাগ অবশ্যই তালিকা দেখে গোছাতে শুরু করুন।

হালকা কিন্তু ঢাকা পোশাক পড়ুন
ট্রেকিং এ পোশাক অবশ্যই হালকা রঙের হবে এবং ওজনেও হালকা হবে। সুতি পোশাক পরুন যাতে কাপড়ের মধ্য দিয়ে সহজে বাতাস চলাচল করতে পারে। পাহাড়ে এমন অনেক জায়গা পাবেন যেগুলো এতই খাড়া যে পায়ের সাথে হাতও ব্যাবহার করতে হবে উপরে উঠতে হলে। এমন পোশাক বেছে নিন যাতে পথ যেমনই হোক আপনার পোশাক সেখানে বাঁধা হয়ে না দাঁড়ায়। ট্রেকিং যেমন রাতে হতে পারে তেমনি দিনেও হতে পারে। রোদ থেকে বাচঁতে সানস্ক্রিন তো অবশ্যই ব্যবহার করবেন, সাথে পোশাকটিও পরুন ফুল হাতা। রোদে হাত-পা, গলার ত্বক পুড়ে যায় যা ক্লান্তিবোধ বাড়ায়।

বিরতি নিন
প্রতি আধঘন্টার ট্রেকিং এ ২ থেকে ৫ মিনিটের বিরতি নিন। প্রতি ঘন্টায় অন্তত ৭ থেকে ১০ মিনিট বিশ্রাম নিন। আর দুপুর বা রাতের খাবারের বিরতি নিন ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘন্টা। চেষ্টা করুন খাবার সময়মত খেতে। অনেক সময় দেখা যায়, খাবার আমরা সাথেই বহন করি কিন্তু নির্দিষ্ট দূরত্ব অতিক্রম না করে খেতে বসি না। খাবারের অভাব আপনার শরীরকে দুর্বল করে দেবে। এতে পরের দিনের ট্রেকিং এ আপনি আরও ক্লান্ত বোধ করবেন। রুটি, পাউরুটি নয়। পুষ্টিকর খাবার যা দ্রুত শক্তি দেয় এমন কিছু খান।

সানগ্লাস, সানস্ক্রিন আর ক্যাপ
রোদ ট্রেকিং এ আপনার পরম বন্ধু, কারণ বৃষ্টির চেয়ে রোদ ভালো। আবার রোদই আপনার পরম শত্রু। কারণ শরীরের সমস্ত শক্তি সে শুষে নিতে থাকে। তাই ব্যাগে সানগ্লাস, সানস্ক্রিন আর ক্যাপ রাখুন। ক্যাপ না থাকলে গামছা দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিন। সানস্ক্রিন ঘামের কারণে ধুয়ে যায়। তাই যেখানেই পানি পাবেন হাত মুখ ধুয়ে আবার লাগিয়ে নিন।

সাধারণ এই টিপসগুলো অনুসরণ করুন। দেখবেন, অন্য সময়ের তুলনায় ক্লান্তি নেমে এসেছে অর্ধেকের কোঠায়। পাহাড়ি পথে ক্লান্তি কিছুটা তো থাকবেই। তবে একে নিয়ন্ত্রণ করা বা কমিয়ে আনা কিন্তু আপনারই হাতে। ট্রেকিং এর অভিজ্ঞতা ক্লান্তিকর দুঃস্বপ্নের মতো না হয়ে হোক চিরস্মরণীয় এবং আনন্দের।

মিশন অন্নপূর্ণা
অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প ট্রেক ছিল আমার জীবনের অন্যতম সেরা অভিজ্ঞতা। এ বছরের এপ্রিল মাসে ৭ দিনের ট্রেক শেষ করি, যেখানে পৌঁছেছিলাম ৪,১৩০ মিটার উচ্চতায়। এই ট্রেক ছিল একধরনের আত্ম-আবিষ্কার—শুধু প্রকৃতির সৌন্দর্য নয়, নিজের সীমাবদ্ধতাও যাচাই করার সুযোগ পেয়েছি।

এ ধরনের ট্রেকিংয়ে অনেক প্রশ্ন মনে আসে—আমি কি শেষ পর্যন্ত পারবো? শারীরিক সক্ষমতা কি আমাকে লক্ষ্যে পৌঁছাতে সাহায্য করবে? মানসিক শক্তি কি অটুট থাকবে? প্রকৃতি কি আমার পক্ষে থাকবে, নাকি তার রুদ্র রূপের মুখোমুখি হতে হবে? তবে, এসব প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে রোমাঞ্চের আসল স্বাদ। যখন হিমালয়ের পথে প্রথম পা রাখি, তখন মনে হয়েছিল, আমি এক নতুন চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে, যেখানে প্রকৃতি আর মানসিক শক্তির এক অবিরাম লড়াই।

যাত্রা শুরু হয়েছিল পোখারা শহর থেকে। পাহাড়ি পথ, সরু গলি আর ঠান্ডা বাতাস প্রতিটি পদক্ষেপে নতুন রোমাঞ্চের আভাস দিচ্ছিল। প্রথমে গন্ড্রুক গ্রামে পৌঁছাই, যেখানে স্থানীয় গুরুং সম্প্রদায়ের উষ্ণ আতিথেয়তা আমাদের ক্লান্তি দূর করে দেয়। এরপর, খাড়া পাথুরে পথে উপরে উঠতে থাকি। ধীরে ধীরে তুষারাবৃত অন্নপূর্ণার চূড়াগুলি আমাদের সামনে প্রকাশ পেতে থাকে। প্রকৃতির এমন সৌন্দর্য দেখে মনে হচ্ছিল, সমস্ত ক্লান্তি যেন কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে।
 

অবশেষে, যখন অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে পৌঁছালাম, সূর্যোদয়ের আলোয় বরফে মোড়া অন্নপূর্ণার চূড়াগুলি সোনালি আলোয় ঝলমল করছিল। সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, এমন দৃশ্য যেন স্বপ্নেই দেখা যায়। এই ট্রেক কেবল পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখার জন্য ছিল না, বরং পথে পথে স্থানীয় গুরুং, মাগার, থাকালি এবং লোবা সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগও পেয়েছি।

এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে আমরা প্রকৃতির সামনে কত ক্ষুদ্র। জীবনে বিনয়ী থাকা ও উদারতা প্রকাশ করাই আসল শিক্ষা। প্রতিটি পদক্ষেপে অজানা পাখির গান, পাহাড়ি ফুলের সৌন্দর্য, আর স্থানীয়দের আন্তরিকতা আমার মনকে অনুপ্রাণিত করেছে।

অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির বিশালতা উপলব্ধি করার মুহূর্ত ছিল একান্ত অনির্বচনীয়—এমন কিছু অভিজ্ঞতা থাকে, যা ছবিতে ধরা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়। এই ট্রেক আমার জীবনের এক অনন্য অভিজ্ঞতা, যা চিরকাল হৃদয়ে অমলিন স্মৃতি হয়ে থাকবে।