পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

শেখ শাহরিয়ার জামান: সরকারি চাকরিতে কোটাপ্রথা সংস্কারকে কেন্দ্র করে ছাত্রদের আন্দোলন পরবর্তী সময়ে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলনের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর পুলিশ, প্রশাসন, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন জায়গার কর্ম-পরিচালনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনার প্রয়াস নেওয়া হয়। একইভাবে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও। গত ছয় সপ্তাহে মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে বড় পরিবর্তন আনা হয়েছে। একই সঙ্গে পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নের যে চ্যালেঞ্জ, সেটিতেও পরিবর্তন এসেছে।

নেতৃত্বে পরিবর্তন
৮ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর মন্ত্রী পদমর্যাদায় পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন সাবেক কূটনীতিক মো. তৌহিদ হোসেন। উপদেষ্টা পরিষদের শপথ গ্রহণের দিনই ধারণা করা হচ্ছিল তৌহিদ হোসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হবে এবং সেটিই হয়েছে। পররাষ্ট্রনীতি বাস্তবায়নের জন্য দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই মন্ত্রণালয়ের সবার সঙ্গে বৈঠক করার পাশাপাশি প্রথা-মাফিক বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করছেন তিনি। একইসঙ্গে সরকারের পররাষ্ট্র নীতি সম্পর্কিত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডও মিডিয়ার কাছে নিয়মিতভাবে ব্যাখ্যা করে চলেছেন।

সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই চীনে বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূত মো. জসিম উদ্দিনকে ঢাকায় ডেকে পাঠানো হয়। পরে তিন সপ্তাহের মধ্যে নতুন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তিনি। বিসিএস ১৩ ব্যাচের চৌকস কর্মকর্তা জসিম উদ্দিন একজন দক্ষ কূটনৈতিক হিসেবে পরিচিত। সরকার নির্ধারিত পররাষ্ট্র নীতি বাস্তবায়নের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। একইসঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার পাশাপাশি মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্বও পালন করছেন।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে রাষ্ট্রাচার প্রধান। সরকার পরিবর্তনের পর এই দায়িত্ব দেওয়া হয় খন্দকার মাসুদুল আলমকে। বিসিএস ২১ ব্যাচের মেধাবী অফিসার মাসুদুল আলম এর আগে রাষ্ট্রাচার অণুবিভাগে ডেপুটি চিফ অফ প্রটোকল হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে তিনি উত্তর আমেরিকা অণুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন।

সম্প্রতি জাতিসংঘ অণুবিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় রাহাত বিন জামানকে। নিউ ইয়র্ক বা জেনেভার বাংলাদেশ স্থায়ী মিশনে কাজ করেনি, সাধারণভাবে এমন কাউকে জাতিসংঘ অণুবিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয় না। কিন্তু রাহাত বিন জামান এর ব্যতিক্রম। কার্যকরী মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার বিবেচনায় এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। 

পররাষ্ট্র নীতির দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বন্ধু হিসেবে পরিচিত ছিল ভারত। অন্যদিকে পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র।

এটি কোনও গোপন বিষয় নয় যে, আওয়ামী লীগ সরকার পতনকে ভালো চোখে দেখেনি ভারত। এর প্রতিফলন দেখা যায় ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে নেতিবাচক সংবাদ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ভুল তথ্য দিয়ে খবর প্রচারের মাধ্যমে। ফলে এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারত।

অন্যদিকে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মাদ ইউনূসের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর নেতৃত্বের সঙ্গে সবসময় সুসম্পর্ক ছিল এবং আছে। ফলে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের দৃষ্টিভঙ্গিরও বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। নাগরিক অধিকার যেমন গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও আইনের শাসনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে তারা এখন বাংলাদেশ সম্পর্কে ভিন্নভাবে মূল্যায়ন করছে।

এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘পরিস্থিতির পরিবর্তন হলে দেশের অবস্থানেরও পরিবর্তন হয়। কূটনীতিতে চিরস্থায়ী মিত্র বা শত্রু বলে কিছু নেই। পররাষ্ট্র নীতির সবকিছু আবর্তিত হয় জাতীয় স্বার্থকে কেন্দ্র করে।’

ভারতের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গা হচ্ছে ওই দেশের নিরাপত্তা। দিল্লির পররাষ্ট্র নীতিতে ঢাকা একটি বড় জায়গায় থাকবে। কিন্তু ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্যগুলিতে নিরাপত্তা বিঘ্নিত না হলে, বাংলাদেশ নিয়ে তারা বড় আকারে হস্তক্ষেপ করবে না বলে মনে করেন সাবেক ওই রাষ্ট্রদূত।

রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে রদবদল
আওয়ামী লীগ আমলে আমলাদের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ একটি নিয়মিত বিষয় ছিল। সাধারণভাবে অভিযোগ হচ্ছে রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যবহার করে এবং অর্থের বিনিময়ে ওই মেয়াদ বৃদ্ধির প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হতো। একইভাবে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতদের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আট জন রাষ্ট্রদূত যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে ছিলেন, তাদের দেশে ডেকে পাঠায়। এছাড়া আগামী ডিসেম্বরে আরও ছয় জন পেশাদার কূটনীতিক রাষ্ট্রদূত হিসেবে অবসরে যাবেন এবং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হবে না। ফলে আগামী ছয় মাসের মধ্যে অন্তত ২৫টি দূতাবাসে রাষ্ট্রদূত পর্যায়ে পরিবর্তন আনতে হবে।

এ বিষয়ে একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘এত অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো সংখ্যক রাষ্ট্রদূত নিয়োগের ঘটনা এর আগে হয়নি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র সচিব বিষয়টি নিয়ে কাজ করছেন। যে দূতাবাসগুলো এখন খালি আছে, সেগুলোতে প্রথমে রাষ্ট্রদূত দেওয়া হবে।’

আগামী ডিসেম্বর বা এরপরে যে দূতাবাসগুলো খালি হবে, সেগুলোতে পরবর্তী ধাপে রাষ্ট্রদূত নিয়োগের প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে বলে তিনি জানান।

মন্ত্রণালয় নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণা
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং পেশাদার কূটনীতিকদের নিয়ে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে নেতিবাচক প্রচারণা ছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর এটির মাত্রা অত্যন্ত দৃশ্যমান। সবচেয়ে বড় আশঙ্কার জায়গা হচ্ছে পেশাদার কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন নেতিবাচক প্রচারণা সামাজিক গণমাধ্যমের পাশাপাশি মেইন স্ট্রিম মিডিয়াতেও প্রচার হচ্ছে। অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস করার একটি অপচেষ্টা বলে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

এ বিষয়ে জ্যেষ্ঠ একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘পরিস্থিতি পরিবর্তন হলে বিভিন্ন জনের যে ক্ষোভ সেটির প্রকাশ পায়। কিন্তু এই ক্ষোভ যদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে ক্ষতির জন্য হয়ে থাকে, তবে এর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন সঙ্গত কারণে উঠবে।’

উদাহরণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘দুর্নীতি দমন কমিশন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রায় ৪০ জন কর্মকর্তা এবং কর্মচারীর বিষয়ে তথ্য চেয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে দুদকের চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছানোর আগে সেটি মিডিয়াতে ফাঁস করে দেওয়া হয় এবং ওই কূটনীতিকদের দুর্নীতিবাজ হিসেবে অভিযোগ করা হয়। এটি যে কোনও বিবেচনায় উদ্দেশ্যমূলক।’

আরেকজন কর্মকর্তা জানান যে, সামাজিক গণমাধ্যমে যেসব পেশাদার কূটনীতিকদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ করা হচ্ছে, তারা সবাই দক্ষ কূটনীতিক হিসাবে পরিচিত। সামাজিক গণমাধ্যমের বক্তব্য দেখে মনে হচ্ছে যারা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে একটি গ্রুপ নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে মন্ত্রণালয়ের ক্ষতি করার চেষ্টা করছে।

তিনি বলেন, ‘এটি বন্ধ হওয়া দরকার। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সরকারের এমন একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান যার ক্ষতি হলে দেশের ক্ষতি হবে। কূটনীতিকদের সম্মান নষ্ট করার যে অপচেষ্টা চলছে, সেটি সফল হলে বিদেশিদের সঙ্গে বাংলাদেশ কখনোই ঠিকমতো স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারবে না।’