● অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতন করে জোরপূর্বক পদত্যাগ করানো হচ্ছে শিক্ষকদের
● আন্দোলনে অংশ নেননি এসব অভিযোগেই পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে শিক্ষকদের

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছিরের পদত্যাগের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে | ছবি: সংগৃহীত

নিজস্ব প্রতিবেদক: আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারাদেশে বিভিন্ন বিভাগে ‘পদত্যাগের’ হিড়িক পড়েছে৷ ব্যতিক্রম নয় শিক্ষা বিভাগেও৷ কিছু ‘স্বেচ্ছায়’ পদত্যাগের ঘটনা ঘটলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতন করে জোরপূর্বক পদত্যাগের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

এমনকি অনেক শিক্ষককে জোর করে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে আবার অনেক শিক্ষক পালিয়ে বেড়াচ্ছেন৷ জোরপূর্বক পদত্যাগের চাপ, অপমান আর হেনস্তার আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন অনেক শিক্ষক।

এরই মধ্যে সরকার পরিবর্তনের পর কিছু কিছু জায়গায় শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের পদত্যাগে বাধ্য করেছে। এমনকি কিছু স্থানে দেখা গেছে শিক্ষকদের সাথে শিক্ষার্থীদের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণও।

বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে খবর আসতে থাকে যে, কোনও কোনও শিক্ষক হেনস্থার শিকার হচ্ছেন। শিক্ষকদের ঘেরাও করে পদত্যাগে বাধ্য করা, অপমান-অপদস্থ করা এবং বাড়ি বাড়ি গিয়ে হুমকি দেবার অভিযোগও আছে।

একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক জানান, সম্প্রতি তিনি নিজ দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেছেন। কিন্তু তারপরও শিক্ষার্থীরা সন্তুষ্ট হয়নি। শিক্ষার্থীরা চাচ্ছিলো তিনি (শিক্ষক) যেন সবার সামনে গিয়ে পদত্যাগ করেন।নিরাপত্তার কারণে এবং ‘আবারও হয়রানির ভয়ে’ তিনি নিজের পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি।

ওই শিক্ষক বলেন, ছাত্রদের হাতে 'অপমানিত হওয়া' ঠেকাতে তিনি বিভাগে যাওয়ার সাহস করেননি। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তাকে অফিসে যাওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিল। 

তিনি বলেন, 'আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, তারা ভিডিও করবে এবং সেখানে গেলে যে কোনো একটা খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। তাই শেষ পর্যন্ত আমি যেতে রাজি হইনি।'

কিন্তু বিভাগে না গেলেও ঐ শিক্ষকের ঠিকানা সংগ্রহ করে তার বাসভবনের দিকে চলে আসছে খবর পেয়ে আতঙ্কে পড়ে যান ওই শিক্ষকের পরিবার। তাদের পুরো ভবনেই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তিনি তখন পরিবারসহ তার বাসা ছেড়ে অন্য স্থানে চলে যেতে বাধ্য হন।

নাম-পরিচয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক জানাচ্ছেন, 'তিনি আওয়ামী লীগ পন্থি নীল দলের সদস্য এবং শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে অংশ নেননি এসব অভিযোগেই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। তবে তার পরিবারকে কেনো টার্গেট করা হবে, এ নিয়ে ক্ষোভ জানান তিনি।'

বাংলাদেশে গত ৫ই অগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা একে একে পদত্যাগ করতে থাকেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পরিস্থিতি আসলে কেমন? আর ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কই বা এখন কোন অবস্থায়?

আতঙ্কে অনেক শিক্ষক 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষক চন্দ্রনাথ পোদ্দার। গত ২১শে অগস্ট নিজ বিভাগে কাজ শেষে জানতে পারেন নিচে শিক্ষার্থীরা তার জন্য অপেক্ষা করছেন।

ছাত্র আন্দোলনে তিনি কেন শিক্ষার্থীদের পক্ষে ভূমিকা রাখেননি? কেন তিনি নীল দলের কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন?

এসব বিষয়ে প্রশ্ন করা হয় তাকে। পরে অন্য শিক্ষকদের মাধ্যমে তাকে জানানো হয় যে তার ক্লাস বয়কট করা হবে। ছাত্র আন্দোলনে পোদ্দার অংশ নেননি, এই অভিযোগে তাকে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি ছেড়ে দিতে চাপ দেয় শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীদের হইহুল্লোড় এবং নানামুখী প্রশ্নে বিপর্যস্ত এই শিক্ষক এখন আর বিভাগে যাচ্ছেন না। 

পোদ্দার অবশ্য মনে করেন, শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ ‘যৌক্তিক’। তিনি আশা প্রকাশ করেন, অচিরেই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও কোনও শিক্ষককে যে হেনস্তা করা হচ্ছে এবং জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে সেটা সম্প্রতি ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল বাছিরের পদত্যাগের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর। 

ওই ভিডিওটিতে দেখা যায়, শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে তাদের দাবি অনুযায়ী পদত্যাগের কাগজপত্রে সই করছেন এই শিক্ষক। ঘটনার পর থেকেই আব্দুল বাছির অনেকটা লোকচক্ষুর আড়ালে। প্রতিবেদকের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও আর কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

গত সপ্তাহে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হেনস্থার ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন এমন একাধিক অধ্যাপক জানিয়েছেন, তার বিভাগের কনিষ্ঠ এক শিক্ষককে ‘হাতজোড় করে মাফ চাইতে বাধ্য করেছে’ শিক্ষার্থীরা।এছাড়া তাৎক্ষণিক বিভাগীয় একটি দায়িত্ব থেকেও পদত্যাগ করিয়েছে, করছে মানসিক নির্যাতন।

কিন্তু ‘নির্যাতন ও হেনস্থার শিকার’ ওই শিক্ষকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে এরকম ঘটনার কথা এড়িয়ে যান তিনি। জানান, শিক্ষার্থীরা তাকে কোনও চাপ দেয়নি বরং তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।

'আত্মহত্যা করতে চেয়েছিলাম' 

অপমান-অপদস্থের শিকার হয়েছেন, অন্য শিক্ষকদের কাছে নিজেই ফোন করে সাহায্য চেয়েছেন এবং শিক্ষার্থীদের হামলার ভয়ে ক্যাম্পাসে থাকছেন না এমন শিক্ষকেরা গণমাধ্যমের সাথে কোথাও বলতে চাচ্ছেন না।

নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক জানান, অপমানের কারণে আত্মহত্যা করার কথাও ভেবেছিলেন তিনি।তিনি জানান, 'ওরা নানারকম গালিগালাজ করছিলো। আমি সরকারের সমর্থক এমন কথা বলছিলো। একপর্যায়ে আমার সেই পুরুষ সহকর্মী আমাকে মারারও চেষ্টা করে। পরিস্থিতি এতোটা অসম্মানজনক ছিল যে, আমি পরে আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলাম,' বলছিলেন সে শিক্ষক।

ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে ফাটল? 

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যাচ্ছে, মূলত: আওয়ামী পন্থি শিক্ষক এবং যারা সরাসরি আন্দোলনের পক্ষে কথা বলেননি, অনেক ক্ষেত্রে তারাই হেনস্থার মুখে পড়েছেন। শিক্ষকদের নামে ব্যানার বানিয়ে, তালিকা করে, ফেসবুকে প্রচারণা চালিয়ে যেমন টার্গেট করা হয়েছে, তেমনি অনেককে বাসায় গিয়েও হুমকি দেয়া কিংবা খোঁজ করা হয়েছে।

সবমিলিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যে অবস্থা তাতে করে 'ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্ক ধ্বংস হওয়ার' মুখোমুখি বলেই মত রাজনীতি বিশ্লেষক জোবাইদা নাসরীনের। 

তিনি বলেন ‘শিক্ষকদের কেউ কেউ এখন ভয়ে, আতঙ্কের মধ্যে আছেন। সবাই একটা ভয়ের মধ্যে আছে যে কোন কথায় কী প্রতিক্রিয়া হবে। শিক্ষার্থীরা আবার তেড়ে আসবে না তো?' 

জোবাইদা নাসরীন মনে করছেন, 'শিক্ষকদের অপমান-অপদস্থ হওয়ার ঘটনায় বিভিন্ন পক্ষ জড়িয়ে পড়ছে। তাঁর মতে, ভয়-দ্বিধা কাটিয়ে শিক্ষকরা কীভাবে শ্রেণিকক্ষে ফিরবেন সেটা একটা বড় প্রশ্ন। আবার শিক্ষার্থীরাও কীভাবে তাদের গ্রহণ করবেন সেটাও বোঝা যাচ্ছে না।

কিন্তু এমন অবস্থা কেন তৈরি হলো? এর পেছনে শিক্ষকদেরও দায় দেখছেন জোবাইদা নাসরীন। 'অনেকে লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলেন। শিক্ষার্থীদের উপর নিপীড়ন হলে সেটা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখেননি। তবে শিক্ষার্থীরা যেটা করতে পারতো যে, কোনও শিক্ষকের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ থাকলে অপেক্ষা করতে পারতো। প্রশাসনিক নিয়োগগুলো হয়ে গেলে তারা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে দাবি তুলে ধরতে পারতো,' বলেন জোবাইদা নাসরীন।

তবে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বায়ক আবু বাকের মুজমদার বলছেন, 'তাদের পক্ষ থেকে চেষ্টা আছে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার।

তিনি দাবি করেন, শুরুর দিকে যে-সব ঘটনা ঘটছিল এখন সেগুলো কমেছে। এমনকি যারা এসব করছিল তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কাউকে হেনস্তা না করার বার্তা পৌঁছে দেয়া হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

তবে বাস্তবতা হচ্ছে এর পরও এমন ঘটনা থেমে নেই। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও নেই দৃশ্যমান কোন উদ্যোগ। এমনকি উপাচার্য ও অন্যান্য পদগুলোতে দ্রুত নিয়োগ দেয়ার মাধ্যমে প্রশাসনিক কার্যকারিতাও তৈরি করতে পারেনি সরকার।

যদিও এর মধ্যেই মঙ্গলবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দায়িত্ব নিয়েছেন নতুন উপাচার্য। মনে করা হচ্ছে, এভাবে পর্যায়ক্রমে সব বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু হলে পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটবে। কিন্তু এর মধ্যেই ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে যে 'ভীতি এবং আস্থাহীনতা' তৈরি হয়েছে সেটা সহজে কাটবে বলে মনে হচ্ছে না।