🎓শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
● বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, বিদ্যালয়–সর্বত্র একই অবস্থা।
● চেয়ার থেকে টেনে তুলে বের করার ঘটনাও ঘটেছে।
● পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা শিক্ষাবিদদের।
● ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ।
শিক্ষক | অলংকরণ: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার গড়েয়া ইউনিয়নের চখমিল বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়। গত ২৫ আগস্ট বিদ্যালয়টির শিক্ষকদের অবরুদ্ধ ও হেনস্তা করে একদল শিক্ষার্থী। পরে প্রধান শিক্ষকসহ চার শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর করায় তারা। চার দিন পর ২৯ আগস্ট শিক্ষার্থীরা নিজেদের ‘ভুল’ বুঝতে পেরে সেই শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে এনেছে।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে সারা দেশে বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ ও পদত্যাগে বাধ্য করার হিড়িক পড়েছে। শিক্ষকদের, বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানদের হেনস্তা, মারধর, এমনকি টেনে চেয়ার থেকে তুলে দপ্তর থেকে বের করে দেওয়ার বেশ কিছু ঘটনাও ঘটেছে। তবে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও বিদ্যালয়ের কত শিক্ষককে জোরপূর্বক পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে, তার হিসাব শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে নেই।
শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের হাতে প্রতিষ্ঠান প্রধানদের এমন লাঞ্ছনার প্রতিবাদও হচ্ছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাচ্ছেন জোরপূর্বক পদত্যাগ ও লাঞ্ছনার। শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, শিক্ষক যদি সম্ভ্রম হারান, তাহলে তাঁর আর কিছুই বাকি থাকে না। এতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা ও হেনস্তা করার ঘটনা খুবই দুঃখজনক, অনভিপ্রেত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা ফৌজদারি অপরাধ।
জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করার ঘটনা ঘটেছে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও। গত ১৯ আগস্ট শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আবদুল বাছির ও চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কয়েকজন শিক্ষককে হেনস্তা করার অভিযোগও উঠেছে। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন।
ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর দেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্যসহ প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকেরা একে একে পদত্যাগ করেছেন। তাঁদের বেশির ভাগই স্বেচ্ছায় ও শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে পদ ছেড়েছেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের আপত্তির মুখেও পদত্যাগ করেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য।
ঠাকুরগাঁওয়ের চখমিল বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের পদত্যাগে বাধ্য করা শিক্ষকদের শিক্ষার্থীরাই ফিরিয়ে আনলেও বাকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-প্রধানদের ভাগ্যে এমন ঘটেনি। জানা গেছে, ২৯ আগস্ট বরিশালের বাকেরগঞ্জ সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ শুক্লা রানী হালদারকে অবরুদ্ধ করে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। একই রকম ঘটনার শিকার হন নওগাঁর হাঁপানিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ নুরুল ইসলামও।
দেশের বিভিন্ন কলেজ শুধু নয়, বিদ্যালয়েও পদত্যাগের একই চিত্র। রাজধানী ঢাকায়ও বিভিন্ন স্কুল-কলেজে শিক্ষার্থীদের চাপে পদত্যাগপত্রে সই করেছেন প্রতিষ্ঠানপ্রধানেরা। সরকারি-বেসরকারি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই একই চিত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ করানো এবং হেনস্তার ঘটনায় সাধারণ শিক্ষকেরা আতঙ্কিত। এ কারণে অনেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অনিয়মিত। যাঁরা যাচ্ছেন তাঁরাও কিছু সময় পর চলে আসছেন।
সারা দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্তত ২০ জন শিক্ষক জানান, এর আগে দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলেও শিক্ষকদের কখনো এমন বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়তে হয়নি। এবারই ব্যাপক হারে শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও হেনস্তার ঘটনা ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষকদের ক্লাসে যেতেও বাধা দেওয়া হচ্ছে। মারধর, লাঞ্ছনার ঘটনাও ঘটছে। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় তাঁরা পারিবারিক, সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন। এতে অনেকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
শিক্ষাবিদেরা বলছেন, জোর করে শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য ও হেনস্তা করা কোনোভাবেই দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যায় না। শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা, হেনস্তা করা খুবই ঘৃণিত কাজ। ব্যক্তিগত আক্রোশ, ঈর্ষা, পদোন্নতির লোভ, স্বার্থের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি কারণে অনেক শিক্ষক এমন ঘৃণিত কাজে জড়িয়ে পড়ছেন। ছাত্ররাও বুঝে না বুঝে, প্ররোচিত হয়ে এসব কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। তিনি বলেন, শিক্ষক তাঁর সম্ভ্রম হারালে তাঁর আর কিছুই বাকি থাকে না। এতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়বে। এবারের আক্রমণ কিন্তু মূল ধারার ওপর হচ্ছে। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও থাকতে পারে।
শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও হেনস্তা কোনোভাবেই মানা যায় না মন্তব্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক অধ্যাপক তাহমিনা আখতার বলেন, এর পেছনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিল হিসাব, ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়া ইত্যাদি বিষয় জড়িত। এতে পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, সারা দেশে কত শিক্ষক পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন বা হেনস্তার শিকার হয়েছেন, তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য শিক্ষা প্রশাসনের কাছে নেই। শুধু যেসব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ স্বেচ্ছায় পদত্যাগপত্র মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন, সেই হিসাব রয়েছে। এসব পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে ইতিমধ্যে তাঁদের মূল পদে (বিভাগে অধ্যাপক পদে) দায়িত্ব পালনের নির্দেশও দেওয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে গত শনিবার অন্তর্বর্তী সরকারের শিক্ষা ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা ও হেনস্তার ঘটনা শুধু শিক্ষাঙ্গনের পবিত্রতা ও ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে এটা ফৌজদারি অপরাধও। এ ধরনের ঘটনা রোধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, শুধু মতাদর্শ বা দলীয় পরিচয়ের কারণে শিক্ষকদের হেনস্তা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেও নিয়মমাফিকভাবেই এগোতে হবে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে কোনো লাভ হবে না।
শিক্ষকদের যে প্রক্রিয়ায় পদত্যাগ করানো হচ্ছে, তা সমর্থনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় তিনি বলেন, ‘কোনো শিক্ষার্থী তার শিক্ষকদের পদত্যাগে বাধ্য করতে পারে না। অনেক শিক্ষার্থী হয়তো জানেই না যে তাদের ব্যবহার করে অন্য শিক্ষক এ কাজটি করাচ্ছেন ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য। যারা বিভিন্ন উদ্দেশ্যে অন্যায় প্রক্রিয়ায় এ কাজগুলো করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।’