প্রতীকী ছবি

আয়নাল হোসেন, ঢাকা: গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের অ্যান্টিহিস্টামিন ওষুধ ডেসলোনা ট্যাবলেটের ২০২২ সালের একটি ব্যাচ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ড্রাগ কন্ট্রোল ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে মানবহির্ভূত পাওয়া গেছে। এ কারণে ওষুধটির উৎপাদন ও বাজারজাত স্থগিত করে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর।

জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ন্যাপ্রোক্সেন প্লাস ৫০০ + ২০ ট্যাবলেটটি ২০২৩ সালের জুনে উৎপাদিত হয়। এটি মানবহির্ভূত হওয়ায় উৎপাদনের বছরখানেক পর গত ১০ মার্চ বাজার থেকে তুলে নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়।

শুধু জেনিথ বা গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস নয়, সময়ে সময়ে এমন অনেক কোম্পানির ওষুধই মানবহির্ভূত ধরা পড়ে। এসব ওষুধ ব্যবহার না করতে সরকারের ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর থেকে সতর্ক করে দেওয়া হয়। কিন্তু এই বার্তা যাঁদের কাছে পৌঁছানোর দরকার বেশি, সেই ওষুধ বিক্রেতারা বিষয়টি না জানার কথা বলেছেন। এ কারণে তাঁদের কাছ থেকে সাধারণ খুচরা ক্রেতারা এসব ওষুধ কিনে ঝুঁকির মধ্যে থাকছেন।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের হোমপেজে একটি মেনুর লিংকে ক্লিক করলে আসে সতর্কতা দেওয়া ওষুধের তালিকা। এটি রয়েছে ইংরেজি ভাষায়। সেখানে অ্যাটাচমেন্ট হিসেবে বাংলা পিডিএফ ফাইল রয়েছে, যা ডাউনলোড করে পড়তে হবে। রাজধানীর বেশ কয়েকজন খুচরা ওষুধ ব্যবসায়ী এবং ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাঁরা কেউ এভাবে ওয়েবসাইটে ঢুকে সতর্কতা দেখেননি। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী ত্রুটির কথা জানিয়ে সংশ্লিষ্ট প্রস্তুতকারকের জাতীয় পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার কথা। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলেছেন, এটিও তাঁদের চোখে পড়ে না বললেই চলে।

গত ২৮ আগষ্ট মেডিকন ফার্মাসিউটিক্যালসের ২০২৩ সালের জুনে মাসে উৎপাদিত মেডিজোল-৪০০ (ব্যাচ ০১০১৬২৩) ট্যাবলেটটি মানবহির্ভূত পাওয়া যায়। এই ওষুধের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত।

 একই কোম্পানির সিপ্রোল-৫০০ মিলি (০১০৯২৩ ব্যাচ) ট্যাবলেটটি ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তৈরি করা হয়। এটির মেয়াদ ২০২৬ সাল পর্যন্ত। গত ১১ মার্চ ঔষধ প্রশাসন ওষুধটি পরীক্ষা করে মানবহির্ভূত বলে শনাক্ত করে।

মেসার্স মার্কসম্যান ফার্মাসিউটিক্যালস লিমেটেডের সিপ্রোকুইন-৫০০ অ্যান্টিবায়োটিক ট্যাবলেটটি ২০২৩ সালের মে মাসে উৎপাদিত। এর ব্যাচ ০১ই পরীক্ষা করে মানবহির্ভূত পাওয়া যায়।

ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, মানবহির্ভূত ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মাঠপর্যায়ে নিয়মিত নজরদারির সময় সংশ্লিষ্ট ব্যাচের ওষুধ বাজারে পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

খুচরা বিক্রেতারা অন্ধকারে
পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকার মেসার্স এম এস মেডিকেল কর্নারের বিক্রয়কর্মী আরিফুর রহমানকে কয়েকটি কোম্পানির সরকারঘোষিত মানবর্হিভূত ওষুধের নাম বলা হলে তিনি এ সম্পর্কে অবগত নন বলে জানান।

কেরানীগঞ্জের আটিবাজার এলাকার ওষুধ ব্যবসায়ী সফিকুল ইসলাম বলেন, জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালস ন্যাপ্রোক্সেন ওষুধটি বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। উল্লেখিত মানবহির্ভূত অন্যান্য ওষুধও বাজারে রয়েছে।

রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকার একজন ওষুধ ব্যবসায়ী বলেন, কোনো ওষুধ মানবহির্ভূত হলে সেটি তাঁদের কাছে কেউ বলেন না। তবে ওষুধ একেবারে নিষিদ্ধ করা হলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির লোক এসে তাঁদেরকে জানান।

জানতে চাইলে গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের মালিক হারুন-উর-রশিদ বলেন, ১০টি কারণে ওষুধ মানবহির্ভূত হতে পারে। তাঁদের যে ওষুধটি মানবহির্ভূত পাওয়া গেছে, তা বাজার থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে।

জেনিথ ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, তাঁদের উৎপাদিত ন্যাপ্রোক্সেন ওষুধটি বাজারে নকল করা হচ্ছিল। বিষয়টি ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে জানানোর পরও তাঁরা নকলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো কোম্পানির সুনাম ক্ষুণ্ন করেছে। এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে একটি মামলা করা হয়। বেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মামলায় তাঁদের পক্ষে রায় হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলেন, মানবহির্ভূত ওষুধ অবিলম্বে বাজার থেকে তুলে নিতে হবে। এ ব্যাপারে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে দায়িত্ব নিতে হবে। তারা ওয়েবসাইটে যেভাবে সতর্কতা দেয়, সাধারণ তো দূরে থাক, সচেতন মানুষের পক্ষেও তার খবর রাখা সহজ নয়। মানবহির্ভূত এসব ওষুধ বাজারে পাওয়া গেলে দায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি করেন তিনি।

মালিক সমিতির কথা
ঔষধ শিল্প সমিতির কোষাধ্যক্ষ হালিমুজ্জামান বলেন, কোনো কোম্পানির ওষুধ মানবহির্ভূত পাওয়া গেলে তা বাজার থেকে তুলে নেওয়ার সতর্কবার্তা দেয় ওষুধ প্রশাসন। ওই বার্তার একটি অনুলিপি শিল্প সমিতিকে দেওয়া হয়। তবে কোনো কোম্পানি সরকারি নির্দেশনা অমান্য করলে সদস্যপদ বাতিল বা স্থগিত করা ছাড়া সমিতির কিছু করার নেই।

ঔষধ প্রশাসনের ভাষ্য
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আক্তার হোসেন বলেন, যেসব ওষুধ মানবহির্ভূত বলে শনাক্ত হয়েছে, সেগুলো তুলে নেওয়ার জন্য কোম্পানিকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সারা দেশে তাঁদের প্রতিনিধিকে এসব ওষুধ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। মানবহির্ভূত ওষুধ বাজার থেকে তুলে নিয়ে তিনটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে তা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে অবগত করার নির্দেশনাও রয়েছে।