বন্যার্তদের সহযোগিতা করতে টিএসসিতে জমানো টাকার প্লাস্টিকের ব্যাংক নিয়ে আসে এক শিশু | ফাইল ছবি |
নিজস্ব প্রতিবেদক: দেশের বিভিন্ন জেলায় বন্যায় আক্রান্তদের সাহায্যার্থে গত
আগস্টে গণত্রাণ সংগ্রহের ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক সাড়া পেয়েছিলেন বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে অসংখ্য মানুষকে তখন
ট্রাকভরে ত্রাণের মাল নিয়ে সমবেত হতে দেখা গিয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি)।
ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে হাজার হাজার
মানুষ নগদ অর্থ দিয়েছিলেন ত্রাণ তহবিলে। ছোট-বড় অনেকেই তখন নিজের জমানো
অর্থ দান করতে মাটির ব্যাংক হাতে হাজির হয়েছিলেন টিএসসিতে, যা দেখে কেউ কেউ
আপ্লুতও হয়েছিলেন।
কিন্তু ত্রাণ তহবিলে জমা পড়া সেসব অর্থ বন্যার্তদের
সহায়তায় ঠিকঠাক ব্যবহার হচ্ছে কি না, সেটি নিয়ে গত কিছুদিন ধরেই সামাজিক
যোগাযোগ মাধ্যমে এক ধরনের আলোচনা চলছিল।
আলোচনায় নতুন মাত্রা যুক্ত
হয়েছে যখন শনিবার সমন্বয়কদের বার্তা থেকে জানা গেছে যে সংগৃহীত অর্থের
বেশির ভাগই অব্যবহৃত অবস্থায় ব্যাংকে পড়ে রয়েছে। গত শনিবার রাতে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ নিজের
ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টের একটি পোস্টে বলেন, ‘ব্যয় বাদে বাকি টাকা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক শাখা, ইসলামী ব্যাংক ও
মোবাইল ব্যাংকিংয়ে সংরক্ষিত রয়েছে।’
মূলত এই পোস্টের পরেই ত্রাণ তহবিলের টাকার আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠতে দেখা যাচ্ছে।
বিভিন্ন
মহলে চলছে নানান আলোচনা-সমালোচনা। বন্যার্তদের নামে টাকা তুলে কেন সেটি
তাদের সহযোগিতায় ব্যয় করা হলো না, সেই প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। কেউ কেউ আবার
‘অর্থ আত্মসাতের চেষ্টা হচ্ছে’ বলেও অভিযোগ তুলছেন।
কত টাকা অবশিষ্ট রয়েছে
বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১১টি জেলার মানুষের জন্য টিএসসিতে গত ২২ অগাস্ট গণত্রাণ সংগ্রহ কর্মসূচি শুরু করেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
পরবর্তী
দুই সপ্তাহে ওই তহবিলে প্রায় ১১ কোটি ১০ লাখ টাকা জমা পড়েছিল। এর মধ্য
থেকে এখন পর্যন্ত বন্যার্তদের সহায়তায় খরচ হয়েছে প্রায় এক কোটি ৭৫ লাখ
টাকা। অবশিষ্ট প্রায় ৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যাংকে জমা রাখা হয়েছে বলে
জানিয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এ ছাড়া খাবারদাবারসহ
অন্যান্য যত প্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ হয়েছিল, প্রায় ১৯১টি ট্রাকে করে সেগুলো
বন্যাদুর্গত এলাকায় নিয়ে বিতরণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন তারা। চলতি মাসের
শুরু দিকে দেশের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গত ৪ সেপ্টেম্বরের পর নতুন
করে আর গণত্রাণ সংগ্রহ করা হয়নি বলেও প্ল্যাটফরমটির পক্ষ থেকে জানানো
হয়েছে।
সরকারি হিসাবে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক বন্যায় প্রায় ৫৬ লাখ
মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়েছে আক্রান্ত এলাকার কৃষি,
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত। বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে অসংখ্য বাড়িঘর।
অন্যদিকে, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এখন নতুন সংকট হিসেবে সামনে এসেছে
পানিবাহিত রোগের প্রকোপ। দুর্গত এলাকায় শিশুসহ অসংখ্য মানুষ ডায়রিয়াসহ নানা
রোগে আক্রান্ত হচ্ছে, যাদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন
চিকিৎসকরা।
কোনো কোনো এলাকায় খাবার স্যালাইনসহ প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের
সংকটের কথাও শোনা যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিলয় মাহফুজ
ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘অথচ আমাদের সমন্বয়করা ওই সব মানুষের পাশে না
দাঁড়িয়ে ত্রাণের টাকা ব্যাংকে রেখে দিয়েছেন।’
মাহফুজ জানান, তিনি
নিজে ত্রাণ তহবিলে অর্থ দিয়েছেন, পরিবারসহ পরিচিতজনদেরও ত্রাণ কাজে সহায়তা
করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তখন যারেই এই কাজে পার্টিসিপেট করতে
অনুরোধ করছি, কেউই না করে নাই। যে যেভাবে পারছে বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর
চেষ্টা করছে। কিন্তু এত কিছু করে লাভটা হলো কী? এই টাকা কি ব্যাংকে ফেলে
রাখার জন্য তোলা হইছে?
একই প্রশ্ন তুলেছেন বেসরকারি চাকরিজীবী
মাসুমা আক্তার। হতাশা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে, খবরটা শুনে আমি
খুব হতাশ হয়েছি, কষ্ট পেয়েছি। কারণ টিএসসিতে ত্রাণ জমা দিতে গিয়ে ওই
ছেলে-মেয়েদের যে কর্ম উদ্দীপনা আমি নিজের চোখে দেখেছি, তাতে ভেবেছিলাম এদের
হাতে ধরে ভালো কিছু হবে। কিন্তু তারা যে কেন ত্রাণের টাকা ক্ষতিগ্রস্তদের
মাঝে বিতরণ না করে ব্যাংকে ফেলে রাখল, সেটাই মিলাইতে পারতেছি না।’
এদিকে
তহবিলের টাকাটা ব্যাংকে আছে কি না, সেটাই নিয়েও সন্দেহ পোষণ করেছেন কেউ
কেউ। এ বিষয়ে প্রশ্ন তুলে ব্যবসায়ী রেজাউল ইসলাম বলেন, ‘চারিদিকে এখন
যেভাবে সমন্বয়কদের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, ধান্ধাবাজির অভিযোগ শুনতেছি, তাতে
তো টাকাটা আদৌ ব্যাংকে আছে কি না, সেটাই আমার সন্দেহ লাগতেছে। ক্ষমতায় গেলে
সবার চেহারা চেঞ্জ হয়ে যায়।
এদিকে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে বৈষম্যবিরোধী
ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা যেসব সভা-সমাবেশ করছেন, সেটি ঘিরেও প্রশ্ন
তুলছেন কেউ কেউ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মাহফুজ বলেন, ‘ত্রাণের টাকা
ব্যবহার করে উনারা (সমন্বয়করা) নিজেদের আখের গোছাচ্ছেন না-তো! জেলায় জেলায়
এত কিসের মিটিং?’
তবে বন্যার্তদের সহযোগিতার উদ্দেশ্যে গঠিত ত্রাণ
তহবিলের যে ৯ কোটি ৩৫ লাখ টাকা ব্যাংকে রাখা হয়েছে, সেটি নিয়ে দুশ্চিন্তার
কিছু নেই বলে জানাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা।
সমন্বয়কদের একজন হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘ত্রাণ সহায়তার জন্য যত অর্থ আমরা
পেয়েছি, সেগুলোর প্রতিটি পয়সার হিসাব আমাদের কাছে আছে। কাজেই এটা নিয়ে
দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। প্রাথমিক ত্রাণ কার্যক্রমে খরচের পর তহবিলের
বাকি অর্থের বেশির ভাগই জমা রাখা হয়েছে জনতা ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক এবং
ইসলামী ব্যাংকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখায়। চাইলেও সেগুলো কেউ আত্মসাৎ করতে
পারবে না। কারণ সেগুলো বিশেষভাবে খোলা হয়েছে, যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের
একজন শিক্ষকও যুক্ত রয়েছেন। তিনিসহ আরো দুজনের সম্মিলিত সিগনেচার ছাড়া কেউ
টাকা তুলতে পারবে না।’
তিনি আরো বলেন, ‘অর্থের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি
নিশ্চিত করার লক্ষ্যে তহবিলের আয়-ব্যয়ের হিসাব নিরীক্ষা করা হচ্ছে। আমরা
ত্রাণ কার্যক্রমের আয় ও ব্যয়ের ওপর একটি অডিট করছি এবং আগামী কয়েক দিনের
মধ্যে অডিট রিপোর্ট প্রকাশ করা হবে। সিএ ফার্মের প্রফেশনাল ব্যক্তিদের
দিয়েই নিজ দায়িত্বে এটা আমরা করছি, যাতে পরবর্তীতে কেউ কোনো অভিযোগ বা
অপবাদ দিতে না পারে।’
প্ল্যাটফরমের পক্ষ থেকে বিভিন্ন জেলায় যত
সভা-সমাবেশ হচ্ছে, সেগুলোতেও ত্রাণের কোনো অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে না জানিয়ে
তিনি বলেন, ‘কেউ যদি দেখাতে পারে যে, আমরা ত্রাণ তহবিলের কোনো টাকা অন্য
কাজে ব্যবহার করছি, তাহলে যা শাস্তি দেওয়া হবে, বিনাবাক্যে সেটা মাথা পেতে
নেব।’
কিন্তু ঢাকা ও ঢাকার বাইরে যাতায়াত, থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য
খরচ তাহলে কোথা থেকে আসছে-জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র
আন্দোলন শুরু করার পর থেকেই সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছায় আমাদের সহযোগিতা করে
আসছেন, এখনো করছেন। তবে কারো কাছ থেকে কোনো অর্থ সহায়তা নেওয়া হচ্ছে না।
আমরা শুধু সেবাটা নিচ্ছি। এ ক্ষেত্রে কেউ কেউ তাদের গাড়ি দিয়ে আমাদের পৌঁছে
দিচ্ছেন, অনেকে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন, এভাবেই চলছে। তবে এখন
যেহেতু এটা নিয়েও কথা উঠছে, সে জন্য আগামীতে কারা কী ধরনের সেবা দিয়ে
আমাদের সহায়তা করছেন, সেটার তালিকাও আমরা প্রকাশের কথা ভাবছি।’
টাকা ব্যাংকে কেন
ত্রাণ
তহবিলের বেশির ভাগ টাকা পরিকল্পিতভাবেই ব্যাংকে রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছে
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ বিষয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, ‘তহবিল
সংগ্রহের শুরুতেই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে অর্থ সংগ্রহের সঙ্গে সঙ্গে
সব খরচ না করে বেশির ভাগই জমা রাখা হবে। কারণ আগের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা
জেনেছি যে, বন্যার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের পরবর্তী ধাপে ক্ষতিগ্রস্ত
মানুষগুলোর অর্থ সহায়তা বেশি প্রয়োজন হয়। বন্যার পানি নেমে যাওয়ায় এখন ওই
অর্থ ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় ব্যয় করা হবে।’
তিনি বলেন, ‘আরো আগে
থেকেই আমরা ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর নির্মাণসহ অন্য কাজগুলো করে দেওয়ার কথা
ভাবছিলাম, কিন্তু আয়-ব্যয়ের অডিট কমপ্লিট না হওয়ায় সেটা সম্ভব হচ্ছিল না।
নিরীক্ষা শেষ করে শিগগিরই তহবিলের সব অর্থ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের
পুনর্বাসনে ব্যয় করার পরিকল্পনা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্তদের
পুনর্বাসনে সরকার যে তহবিল গঠন করেছে, সেখানেই টাকাগুলো দেওয়া হবে। এর ফলে
সুষ্ঠু ও কার্যকরভাবেই আমাদের তহবিলের অর্থ মানুষের কাজে আসবে বলে আশা
রাখি।’