মতবিনিময় সভায় অতিথিরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শনিবার তৈরি পোশাক খাতে চলমান সংকট ও উত্তরণের পথ নিয়ে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। রাজধানীর উত্তরায় অবস্থিত বিজিএমইএ কার্যালয়ে তৈরি পোশাক কারখানার মালিক, শ্রমিকনেতা, সরকারের তিন উপদেষ্টা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
বেশ কিছুদিন ধরে বেতন-ভাতাসহ বিভিন্ন দাবিতে ঢাকার সাভার, আশুলিয়া ও গাজীপুর শিল্প এলাকায় শ্রমিক অসন্তোষ ও কারখানা বন্ধের ঘটনা ঘটছে। আজও আশুলিয়া এলাকায় শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে অর্ধশত কারখানা বন্ধ রাখে কর্তৃপক্ষ। এই পরিস্থিতিতে সংকট সমাধানে পথ খুঁজতে মতবিনিময় সভার আয়োজন করে বিজিএমইএ।
মতবিনিময় সভার শুরুতে হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে আজাদ বলেন, বর্তমান অবস্থায় সরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিলে তাঁরা কারখানা চালাবেন, না হলে বন্ধ রাখবেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক বিশেষ অর্থায়নের ব্যবস্থা না করলে আমরা বেতন দিতে পারব না। আজকে এ বৈঠকে সকলে মিলে সমাধান দেবেন, যেন আগামীকাল (রোববার) থেকে নির্বিঘ্নে কারখানা চালাতে পারি।’
তদন্তের দাবি
সভায় বেশ কয়েকজন কারখানামালিক বক্তব্য দেন। টানা ১৩ দিন বন্ধ থাকার পরে আজ কাজ শুরু হয় আশুলিয়ার অনন্ত গার্মেন্টসে। প্রতিষ্ঠানটির এমডি এনামুল হক খান সভায় বলেন, আমার কারখানায় শ্রমিকদের সব দাবি মেনে নেওয়ার পরেও আন্দোলন অব্যাহত ছিল। অনেক কারখানায় এমন ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে বিশদ তদন্ত করা প্রয়োজন।
ডেকো লিগেসি গ্রুপের এমডি কল্পন হোসেন বলেন, আন্দোলন শুরুর চার দিন পরে শ্রমিকেরা তাঁদের দাবি জানিয়েছেন। এতে বোঝাই যাচ্ছে, কারও উসকানিতে তাঁরা মাঠে নেমেছেন। রাইজিং গ্রুপের এমডি মাহমুদ হাসান খান বলেন, যে কেউ আইন অমান্য করলে ব্যবস্থা নিতে হবে। এটা নিশ্চিত হলে সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যাবে।
পোশাকশিল্পের মালিকেরা জানান, এরই মধ্যে ভারত, পাকিস্তান ও কম্বোডিয়ার মতো দেশগুলোতে ক্রয়াদেশ (অর্ডার) চলে যাচ্ছে। ফলে পরিস্থিতির দ্রুত উন্নতি না হলে ভবিষ্যতে বড় ক্ষতির মুখে পড়বে দেশ।
নিট পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, শ্রমিকদের যেকোনো ন্যায্য দাবি কারখানায় বসেই সমাধান করা সম্ভব। এ নিয়ে সবাইকে আলোচনার টেবিলে আসতে হবে।
সমাধান চান শ্রমিকনেতারাও
সভায় চারজন শ্রমিক নেতা বক্তব্য দেন। তাঁরা বলেন, পোশাক কারখানায় মধ্যম স্তরের কর্মকর্তারা শ্রমিকদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করেন। বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিজিএমইএ ও শ্রম মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দিয়েও ন্যায়বিচার পাওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে যখন শ্রমিকেরা মাঠে নেমেছেন, তখন আন্দোলনকে বহিরাগত ও পাশের দেশের ষড়যন্ত্র বলা হচ্ছে।
পোশাক কারখানায় বিরোধ নিষ্পত্তি আইন কার্যকর নেই বলে উল্লেখ করেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক বাবুল আক্তার। তিনি বলেন, শ্রমিকদের দাবি নিয়ে শ্রমিকনেতারা কথা বলতে পারেন না। চার শতাধিক শ্রমিককে কালো তালিকাভুক্ত করে রাখা হয়েছে। এসবের সমাধান প্রয়োজন।
পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে দ্রুত সমস্যার সমাধানের জন্য তাগাদা দেন বাংলাদেশ গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সভাপতি মন্টু ঘোষ। একই সঙ্গে তিনি শ্রমিকদের মজুরি পুনর্বিবেচনা করা যায় কি না, সে আহ্বানও জানান।
পরে বক্তব্য দেন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি এস এম ফজলুল হক, আনিসুর রহমান সিনহা, মোস্তফা গোলাম কুদ্দুস, আনোয়ারুল আলম চৌধুরী, সাভার-আশুলিয়া আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও বিএনপি নেতা দেওয়ান মোহাম্মদ সালাউদ্দিন।
অস্থিরতার তিন কারণ
সভার একপর্যায়ে শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তার বিষয় বক্তব্য উঠে আসে। তিনটি প্রধান কারণে তৈরি পোশাক খাতে চলমান অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বলে জানান সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মো. মঈন খান। তিনি বলেন, কিছু বহিরাগত ব্যক্তি কারখানা আক্রমণ করেছিল। সেটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিয়েও সমস্যা তৈরি হয়। বিষয়টির সাময়িক সমাধান হয়েছে; কিন্তু টেকসই সমাধান আসবে রাজনৈতিকভাবে। তবে অস্থিরতার তৃতীয় কারণ হচ্ছে কারখানার অভ্যন্তরীণ বিষয়। এটি সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নয়; বরং মালিক, শ্রমিক ও সরকারের ত্রিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে।
পরিস্থিতি যেন আরও খারাপ না হয়, সেটি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানান শিল্প পুলিশের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) সিবগাত উল্লাহ।
কারখানা খোলা থাকবে
সবাইকে দায়িত্ব নিয়ে চলমান সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান সরকারের মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার। তিনি বলেন, প্রতিযোগী অন্য দেশগুলো আমাদের পোশাকের ক্রয়াদেশ নেওয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। আমরা যেন সে সুযোগ না দিই। দেশকে বাঁচাতে হলে পোশাকশিল্পকে বাঁচাতে হবে।
সভার শেষ পর্যায়ে আজ রোববার শিল্পকারখানা খোলা রাখা হবে কি না, সে বিষয়ে জানতে চান কারখানার মালিকেরা। তখন উপস্থিত উপদেষ্টা, পোশাক কারখানার মালিক, শ্রমিকনেতারা নিজেদের মধ্যে কথা বলেন।
পরে বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, আগামীকাল (রোববার) সব পোশাক কারখানা খোলা থাকবে। তবে কোনো কারখানায় অস্থিরতা হলে সোমবার থেকে সেই কারখানা শ্রম আইনের ১৩ এর ১ ধারা (কাজ নেই, বেতন নেই) অনুযায়ী অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। যদিও পরে বিজিএমইএ এক বিবৃতিতে ‘আইন অনুযায়ী কারখানা বন্ধের’ কথা জানায়।
আগামীকাল দেশের সব তৈরি পোশাকশিল্পের কারখানা চলবে উল্লেখ করে শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, কোনো কারখানায় যদি অস্থিরতা তৈরি হয়, সে ক্ষেত্রে বিশেষ ব্যবস্থা নেবে সরকার। তবে দেশের অর্থনীতিকে বিপদে ফেলতে কেউ যদি কারখানা বন্ধ রাখার অপচেষ্টা করে, তাহলে সেটিও মনে রাখা হবে।
এর আগে সভায় শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, শ্রমিকদের অভিযোগগুলো সমাধানের জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে সরকার। এই কমিটি শ্রমিকদের অভিযোগ ও দাবি নিয়ে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করেছে। এই প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে যারা অস্থিরতা করবে, তাদের বিষয়ে কঠোর হবে সরকার।
আসিফ মাহমুদ আরও বলেন, ‘দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হওয়ায় বাকি সবার মতো শ্রমিকেরাও তাঁদের কথা বলছেন। শিল্পমালিকদের পক্ষ থেকে আন্দোলনে বহিরাগত ব্যক্তিদের যুক্ত থাকার কথা বলা হচ্ছে। তবে কিছু ক্ষেত্রে প্রকৃত (জেনুইন) সমস্যা রয়েছে। অনেক কারখানায় বেতন আটকে আছে। এসব সমাধান করতে হবে। মালিকদের প্রতি আহ্বান জানাব, শ্রমিকদের মধ্যে যেন পুঞ্জীভূত ক্ষোভ তৈরি না হয়, সে জন্য নিয়মিত শ্রমিকদের সঙ্গে বসুন।’