‘এবারের বন্যা ২০০২ সালের চেয়েও অনেক ভয়াবহ’

২৪ ঘন্টার ব্যবধানে আবারো ভারিবর্ষণ ও ঢলের পানিতে ডুবে গেছে খাগড়াছড়ির অধিককাংশ নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি ও সড়ক। ছবিটি মেহেদীবাগ এলাকা থেকে আজ সকালে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি খাগড়াছড়ি: পাহাড়ি শহর খাগড়াছড়ির সমতল ও নিচু এলাকাগুলো এখন পানির নিচে। প্রবল বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ভেসে গেছে খেতখামার ও মাছের পুকুর। ডুবে আছে বিস্তীর্ণ এলাকার বসতবাড়ি। জেলা শহরের সঙ্গে বিভিন্ন এলাকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শহরের প্রবীণ বাসিন্দারা বলছেন, গত ২২ বছরের মধ্যে এমন বন্যা দেখেননি তাঁরা।

খাগড়াছড়ির স্থানীয় বাসিন্দা ও প্রবীণ সাংবাদিক তরুণ কুমার ভট্টাচার্যের মতে, এটি তাঁর দেখা অন্যতম ভয়াবহ বন্যা। তিনি বলেন, ‘খাগড়াছড়িতে সর্বশেষ এমন বন্যা হয়েছিল ২০০২ সালে। এবারের বন্যা সে সময়ের চেয়েও অনেক ব্যাপক ও ভয়াবহ।’

খাগড়াছড়ি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণকেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রহিম বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৫২ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড করা হয়েছে। প্রবল বর্ষণে জেলার চেঙ্গী নদীর পানি বিপৎসীমার ৩৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পাহাড়ি ঢলের পানিতে ডুবে গেছে খাগড়াছড়ির অধিককাংশ নিম্নাঞ্চলের ঘরবাড়ি। ছবিটি আরামবাগ এলাকা থেকে আজ সকালে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

২৪ ঘণ্টায় জেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। জেলার ৯টি উপজেলায় বর্তমানে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার। প্রবল বর্ষণের পাশাপাশি আজ বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটার দিকে শহরে হঠাৎ পাহাড়ি ঢলের পানি ঢুকে পড়ে। এতে শহরের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়ে পড়ে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় দেখা দিয়েছে পাহাড়ধস। মহালছড়ির লেমুছড়ি, মাইসছড়ি ও ২৪ মাইল এলাকায় পানি বেড়ে খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সড়কে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

এর আগে গত মঙ্গলবার বিকেলেও খাগড়াছড়ির নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছিল। তবে গতকাল বুধবার সকালে পানি কমে গেলে আশ্রয়কেন্দ্রে থেকে নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে আসে মানুষ। আজ ভোর থেকে আবারও তারা পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

খাগড়াছড়ি নারানখাইয়া এলাকার মোহিনী দেবী চাকমা (৬৭) বলেন, ‘এত বছর বয়সে এমন বন্যা আমি দেখিনি। এমনকি ঘরেও কখনো পানি ওঠেনি।’

জেলা শহরের ন্যান্সি বাজার, শালবন, কলাবাগান ও কুমিল্লা টিলাসহ কয়েকটি এলাকায় বসতঘরের পাশে পাহাড়ধস হয়েছে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি বলে জানা গেছে। বন্যাকবলিত ও পাহাড়ের পাদদেশে থাকা পরিবারগুলোর জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছে জেলা প্রশাসন।

খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, বন্যাকবলিত লোকজনের জন্য জেলায় ৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। তাদের বিশুদ্ধ পানি এবং খাবার সরবরাহের জন্য প্রতিটি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জেলায় বন্যাকবলিত লোকজনের জন্য চার শ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়েছে। সবাই যেন নিরাপদ স্থানে থাকে এবং খাবার পায় সে চেষ্টা করা হচ্ছে।
বন্যার পানিতে আটকে পড়া একটি পরিবারকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী। ছবিটি খাগড়াছড়ি শহরের গঞ্জপাড়া এলাকা থেকে আজ দুপুরে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

খবংপুড়িয়া এলাকার সুপ্তি চাকমা বলেন, ‘কয়েক দিন আগেও আমাদের বাড়িতে পানি উঠেছিল। গত মঙ্গলবারেও পানি উঠেছে। আজ এখন পর্যন্ত বাড়ি হাঁটুপানির নিচে। ভোরের দিকে হঠাৎ ঢল নেমে আসায় কোনো কিছুই রক্ষা করতে পারিনি। খাবার থেকে জিনিসপত্র সব পানির নিচে। এ বছর তিনবার বন্যাকবলিত হলাম। কোনোবারই কোনো ত্রাণ পেলাম না। এমনকি কেউ খোঁজও করেনি।’

আজ সকালে খাগড়াছড়ি শহরের বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, চেঙ্গী নদী, খাগড়াছড়ি ছড়া ও মধুপুর ছড়ার পানি বেড়ে মুসলিমপাড়া, কালাডেবা, বটতলী, গঞ্জপাড়া, শান্তিনগর, শব্দমিয়াপাড়া, ফুটবিল, মিলনপুর, কলেজপাড়া, মাস্টারপাড়া, নারানখাইয়া, খবংপুড়িয়াসহ বেশ কিছু এলাকার বাড়িঘর ডুবে গেছে। ডুবে গেছে এলাকার সড়ক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও। টানা বর্ষণে মাইনী নদীর পানি বেড়ে দীঘিনালা-লংগদু সড়কের হেডকোয়ার্টার, জোড়াব্রিজসহ চারটি এলাকায় রাস্তা ডুবে গেছে। রাঙামাটির লংগদু ও বাঘাইছড়ির সঙ্গে সারা দেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ডুবে গেছে মেরুং বাজারও।

খাগড়াছড়ি পৌরসভা প্রশাসক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক নাজমুল আরা সুলতানা বলেন, শুরু থেকে পানিবন্দী মানুষের জন্য শুকনা খাবার ও বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। বন্যাকবলিত পরিবারগুলোর জন্য পৌরসভার ভেতরে ১৮টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনে আশ্রয়কেন্দ্র বাড়ানো হবে।

টানা বর্ষণে দীঘিনালার মেরুং, বাবুছড়া ও কবাখালী ইউনিয়নের প্রায় ৩০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দীঘিনালা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মামুনর রশিদ বলেন, বন্যাকবলিত এলাকাগুলোয় ২৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। হাজারের ওপর মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। এ ছাড়া দীঘিনালার সঙ্গে রাঙামাটির বাঘাইছড়ি ও লংগদু উপজেলার যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।

এদিকে পানছড়ি উপজেলার চেঙ্গী নদী, পুজগাং ও লোগাং ছড়ার পানি বেড়ে যাওয়ায় চেঙ্গী ইউনিয়ন ও লতিবান ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। পানছড়ি চেঙ্গী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আনন্দ জয় চাকমা বলেন, ‘আমার ইউনিয়নে আগে কখনো পানি ওঠেনি। এবার কয়েকটি গ্রামে পানি উঠেছে। বেশির ভাগ বাড়ি মাটির এবং বেড়ার হওয়ায় ধসে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ৬৩টি পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।’