নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে কারখানার মূল ফটকের সামনে অবস্থান নিয়েছেন স্বজনেরা। আজ মঙ্গলবার দুপুরে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের খাদুন এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গাজী টায়ার্স কারখানার ছয়তলা ভবনটিতে আবারও আগুন জ্বলে উঠেছে। ফলে মঙ্গলবার ভবনের ভেতরে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব হচ্ছে না বলে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এমন অবস্থায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানে স্বজনদের অপেক্ষা দীর্ঘ হচ্ছে।

 রাত আটটা নাগাদ কারখানা এলাকায় ঘুরে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের আহাজারি দেখা গেছে। তখন পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা ভবনের আগুন পুরোপুরি নেভানোর চেষ্টা করছিলেন। দিনভর সেনাবাহিনী, র‌্যাব, পুলিশ, শিল্প পুলিশ ও বিজিবি সদস্যদের কারখানার নিরাপত্তায় তৎপরতা দেখা গেছে। সোমবারের মতো আজও কারখানা এলাকায় রেড ক্রিসেন্টের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থীদের তৎপরতা ছিল চোখে পড়ার মতো।

আগুন লাগার ৪৮ ঘণ্টা পরেও মঙ্গলবার রাত ৯টা পর্যন্ত নিখোঁজদের বিষয়ে সরকারি কোনো সংস্থার আনুষ্ঠানিক তথ্য পাওয়া যায়নি। ফলে দীর্ঘ সময় ধরে কারখানার বাইরে অপেক্ষমাণ স্বজনদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হচ্ছে। তাঁদের মধ্যে নানা ধরনের গুঞ্জন চলছে, গুজবও ছড়াচ্ছে।

সন্ধ্যা ছয়টায় ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক মো. আলাউদ্দিন বলেন, মঙ্গলবার ভোরে আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছিল। কিন্তু সন্ধ্যায় ফের ভবনে আগুন জ্বলে উঠেছে। তাঁরা পুরোপুরি আগুন নেভানোর চেষ্টা করছেন। ভবনে অনুসন্ধান চালানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করেছিলাম হতাহতের খোঁজে বিকেল নাগাদ পুরো ভবনে অনুসন্ধান চালানো সম্ভব হবে। দীর্ঘ সময় আগুনে পোড়ার ফলে ভবনটি ধসে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে আমরা পরামর্শের জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রকৌশলীদের সহযোগিতা চেয়েছি। দুপুরে তাঁরা ঘটনাস্থলে এসেছেন। কিন্তু প্রচণ্ড তাপের কারণে ভবনে প্রবেশ করতে পারেননি।’

নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী ছাইফুল ইসলাম বলেন, তাঁদের প্রকৌশলীদের একটি দল দুপুরে ভবনটি পরিদর্শনে আসেন। আগুন নিভে গেলেও ভবনটিতে তখনো অতিরিক্ত উত্তাপ ছিল। ফলে তাঁরা ভবনের ভেতরে প্রবেশ করতে পারেননি। বাইরে থেকে দেখেছেন, আগুনের তাপে ভবনটির বিভিন্ন অংশ খসে পড়ছে। কয়েকটি স্থানে তখনো আগুন জ্বলছিল। ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। ফায়ার সার্ভিস আগুন পুরোপুরি নেভাতে সক্ষম হলে পুনরায় পর্যবেক্ষণ করে ভবনে প্রবেশ ও উদ্ধার অভিযান চালানোর বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হবে।

ছয়তলা ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়নি। ভবনের নিচতলায় ঝুঁকি নিয়েই ডাম্পিংয়ের কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। আজ মঙ্গলবার দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

গত রোববার রাত ৯টায় রূপগঞ্জের খাদুন এলাকার কারখানাটির ছয়তলা একটি ভবনে লুটপাট চলাকালে নিচতলায় সিঁড়ির মুখে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে ভবনটির ভেতরে থাকা অনেকেই আটকা পড়েন বলে দাবি করেছেন স্বজনেরা। গাজী টায়ার্স কারখানার মালিক নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। রোববার ভোররাতে রাজধানীর শান্তিনগর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার হন আওয়ামী লীগের এই নেতা।

এদিকে আজ দুপুর পর্যন্ত প্রশাসনের তরফ থেকে নিখোঁজদের কোনো আনুষ্ঠানিক তালিকা না পেয়ে রূপগঞ্জের সাধারণ শিক্ষার্থীরা তালিকা তৈরি শুরু করেছেন। আজ সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত তাঁরা অন্তত ১২৬ জনের নাম তালিকাভুক্ত করেছেন বলে জানিয়েছেন সরকারি মুড়াপাড়া কলেজের স্নাতক শিক্ষার্থী মাহিমা মীর। তিনি বলেন, ‘রোববার রাতে আগুন লাগলেও মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত প্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনো তালিকা করা হচ্ছিল না। নিখোঁজদের স্বজনেরা হাতে ছবি ও জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। গণমাধ্যমে দেখেছি, ফায়ার সার্ভিস একটি নিখোঁজ তালিকা করেছে। কিন্তু আমরা তাদের কাছে জানতে চাইলে তারা অস্বীকার করে। ফলে আমরা দুর্ঘটনায় কতজন নিখোঁজ আছে, তা জানার জন্য দুপুর থেকে তালিকা করা শুরু করি। আমরা নিখোঁজদের নামের পাশাপাশি ভোটার আইডি ও ছবি সংগ্রহ করছি।’

রাত আটটায় ভবনটির প্রধান ফটকে কথা হয় নিখোঁজ ইলেকট্রিক মিস্ত্রি শাহাদাত শিকদার ও সাব্বির শিকদারের বোন রাহিমার সঙ্গে। তিনি জানান, কারখানায় লুটপাট হচ্ছে শুনে রোববার রাত নয়টায় ঘটনাস্থলে এসেছিলেন সাব্বির ও শাহাদাত। এই দুজনের খোঁজে কারখানায় আসেন তাঁদের ভগ্নিপতি জমির আলীও। এর পর থেকে তাঁরা তিনজনই নিখোঁজ।

রাহিমা বলেন, ‘ভাইটার ছোট ছোট দুইটা সন্তান, বোনের তিন মেয়ে। ওদের নিয়ে আমরা কী করব কিছুই জানি না। মানুষ তো একজনের শোক সইতে পারছে না। আমরা তিনজনের শোক কেমনে সইব! ভাই না পাইলেও অন্তত ভাইয়ের লাশটা যেন পাই, সে আশায় আছি।’

রাহিমা জানান, নিখোঁজের পর কারও সঙ্গে আর যোগাযোগ হয়নি। তবে মঙ্গলবার সকাল পর্যন্ত শাহাদাতের মুঠোফোনে ফোন গেছে। ফলে মৃত্যুর শঙ্কার মধ্যেও তাঁদের মনে আশা উঁকি দিচ্ছে, কোনোভাবে যদি নিখোঁজরা ফিরে আসেন। এ কথা বলতে গিয়েই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।