‘শাটিকাপ’ অভিনেতারা পেলেন ব্যাগভর্তি টাকা, সঙ্গে রহস্যজনক কাপ

বিনোদন প্রতিবেদক: তখন রাত তিনটা পেরিয়ে গেছে। রাজশাহী শহরের দুই তরুণ গলির মধ্যে হাঁটছিলেন। তাঁদের চোখ যায় একটি বাড়ির দিকে। একটি ব্যাগ পড়ে ছিল। কৌতূহলবশত ব্যাগে লাথি মারেন আকাশ বিন ওসামা। প্রথমে আকাশ ভেবেছিলেন ফাঁকা ব্যাগ। লাথি মারার পর বুঝতে পারেন, ব্যাগে ভারী কিছু আছে। ব্যাগ খুলে টাকার বান্ডিল ও রহস্যজনক কাপ দেখে রীতিমতো চমকে যান তাঁরা। পরে তাঁরা ঘটনা জানান ‘শাটিকাপ’ ওয়েব সিরিজের নির্মাতা মোহাম্মদ তাওকীর ইসলামকে। এ ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তিনজনই সিরিজের অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলী। গত রাতে ঘটা এ ঘটনা নিয়ে এখন রাজশাহীতে তোলপাড় চলছে।

ঘটনার সময় রাতে আকাশের সঙ্গে ছিলেন আরমান। তাঁরা রাতে রাজশাহী শহরে ভদ্রা মোড়ের ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন শেষে হাঁটতে বের হয়েছিলেন। গাড়ির চাপ তেমন ছিল না। কিছুটা ঘোরাঘুরি করতে গলির মধ্যে প্রবেশ করেন। সেখানে একসঙ্গে অনেকগুলো টাকার বান্ডিল দেখে তাঁরা দুজনই চুপসে যান। ভেবে পাচ্ছিলেন না, কী করবেন। কিছুটা ভয়ও পেয়ে যান। আশপাশে কেউ আছে কি না, ভুলবশত কেউ ব্যাগ রেখেছে কি না, দেখে নেন। কিন্তু কেউ নেই। একটা উপায় বের করার জন্য তাঁরা ফোন দেন তাওকীরকে।

আকাশ বলেন, ‘আমরা তো সিদ্ধান্ত নিতে পারছিলাম না কী করব, আতঙ্কই বলা যায়, এমন অবস্থা। ব্যাগটি নিয়ে আমরা গলি থেকে বের হই। আমরা যেহেতু শুরু থেকে শায়িক (মোহাম্মদ তাওকীর ইসলাম) ভাইয়ের পরামর্শে কাজ করছি। ভাইকে ফোন দিই। ভাই আমাদের সব বুঝিয়ে দেন, কী করতে হবে। সেভাবেই আমরা পরবর্তী পদক্ষেপে যাই। তবে খুবই সাবধান ছিলাম, এটা যেন বারো হাতে না পড়ে। আর কোলাহল যেন না তৈরি হয়।’

৫ আগস্ট সরকার পদত্যাগের পর পরিচালক তাওকীর ইসলামরা দল বেঁধে রাজশাহীকে নিরাপদ রাখতে মাঠে নামেন। পরে ৭ আগস্ট থেকে তাঁরা ‘সেভ রাজশাহী’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম খুলে নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করছেন। হোয়াটসঅ্যাপে তাঁদের গ্রুপ রয়েছে।

তাওকীর ইসলাম বলেন, ‘তখন ভোর সোয়া পাঁচটা। ফোনে টাকার কথা শুনে আমি নিজেই থতমত খেয়ে যাই। প্রথমেই তাদের বলি, আগে টাকাটা নিরাপদে রাখতে হবে। এত টাকা বেহাত যেন না হয়। তারা আর কে কে আছে, সবাইকে একসঙ্গে হয়ে টাকা নিয়ে পরে থানায় যাওয়ার কথা বলি।’

আকাশ টাকার ব্যাগ নিয়ে ভদ্রা মোড়ের পাশে এমএইউ ছাত্রাবাসের গলি থেকে ধীরপায়ে প্রধান রাস্তার দিকে এগিয়ে আসেন। দেশের চলমান পরিস্থিতির কারণে কিছুটা ভয়ও পাচ্ছিলেন। পরে ফোন দেন মাহফুজ প্রদীপ নামের আরেক সহকর্মীকে। তিনিও আসেন। সবাই মিলে দেখেন, ১৮টি এক হাজার টাকার বান্ডিল! তাঁরা পরিকল্পনা করেন, টাকাটা জেলা প্রশাসকের অফিসে জমা দেবেন। পরে তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন থানায় যাওয়ার।

প্রদীপ বলেন, ‘টাকাগুলো পাওয়ার পর একমাত্র চিন্তা ছিল, এটা যেভাবেই হোক সরকারি কোষাগারে পৌঁছে দেব। সবাই মিলেই থানায় যাই। আমাদের সঙ্গে ছিল আসিফ, রিফাত, রিংকু, সজলসহ আরও অনেকে। আমরা থানায় যাই। ১৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা পেয়েছি, সেটা নিয়ে থানায় কথা হয়। পরে সেখান থেকে কোর্টে যাই। সিদ্ধান্ত হয়, টাকা সরাসরি আমরা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেব। সেই সিদ্ধান্ত থেকেই আমরা সবার সঙ্গে কথা বলে এখন (বেলা তিনটা) ডিসি অফিসের ট্রেজারিতে জমা দিচ্ছি। এখানেই আমরা রয়েছি।’

এই অর্থ ব্যক্তিমালিকানাধীন কারও হতে পারে। যার টাকা, তাঁকে ফিরিয়ে দেওয়া প্রসঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথাও বলেছেন এই তরুণেরা। আকাশ বলেন, ‘আমরা ব্যাগের সঙ্গে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য ব্যবহার করা হয়, এমন একটি কাপ পেয়েছি। এটা খুবই রহস্যজনক। এই কাপে ১৮টি বড় দাগ দেওয়া, কিছু ছোট দাগ। এটা সন্দেহজনক। টাকাটা এমন এক জায়গায় পাওয়া গেছে, সেখানে মানুষ তেমন যায় না। এটা হয়তো অন্য কোনো উদ্দেশ্যেই রাখা ছিল।’

বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘পরিত্যক্ত টাকা, এটা সন্দেহজনক। আমরা এর তদন্ত করব। সঙ্গে একটি কাপ পাওয়া গেছে। সেটা আমরা পরীক্ষা করিয়েছি, এটা পিতলের কাপ। সেখানে ১৮টি বড় ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আরও কিছু ছিদ্র কেন, সেটারও তদন্ত হবে।’

মাসুদ পারভেজ জানান, অর্থ ট্রেজারিতে জমা দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। তবে ছয় মাসের মধ্যে অর্থের যদি বৈধ কোনো মালিকানা দাবি করা কাউকে পাওয়া যায়, তাহলে প্রমাণ, অর্থের উৎস জানার পর সেটা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। কাউকে না পাওয়া গেলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা হবে।

রাজশাহীর আঞ্চলিক গল্প নিয়ে ভিডিও স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম চরকির ওয়েব সিরিজ ‘শাটিকাপ’ ও ‘সিনপাট’-এ যুক্ত ছিলেন মাহফুজ প্রদীপ, আকাশ বিন ওসামা, রিফাত বিন মানিকরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন সামাজিক কল্যাণে কাজ করা আরও কিছু তরুণ। তাঁরা এখন মানুষের কাছে বাহবা পাচ্ছেন। সব সময় তাঁরা মানুষের পাশে থাকতে চান।

প্রদীপ বলেন, ‘যাঁরা টাকাগুলো পেয়েছিলেন, তাঁরা কিন্তু অনেক অর্থবিত্তের মালিক নন। তারপরও তাঁরা সততার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁরা প্রতিজ্ঞা করেছেন, এই টাকা বেহাত হতে দেবেন না। এটা তারুণ্যের শক্তি।’ পাশ থেকে তখন ব্যাগে লাথি মারা সেই আকাশ বললেন, ‘এটা গর্বিত হওয়ার মতো কিছু নয়, ভাই। এটা নাগরিক হিসেবে আমার দায়িত্ব ছিল। আমি সেই দায়িত্ব পালন করেছি।’