বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আয়োজনে ঢাকার শাহবাগে সম্প্রীতি সমাবেশে উপস্থিত নেতা–কর্মীরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
ওমর এফ নিউটন: ৫ আগস্ট ২০২৪—দিনটি ইতিহাসের পাতায় খোদাই হয়ে গেল আজন্মকালের জন্য। সেদিন বাংলার ইতিহাসে ঘটে গেল এক যুগান্তকারী ঘটনা। সেদিন পতন হয়েছিল গণতন্ত্রের বৃক্ষের অভ্যন্তরে স্বৈরতন্ত্রের শিকড় গজানো এক সাম্রাজ্যের। সব সাম্রাজ্যেরই একদিন পতন ঘটে, তা যতই শক্তিশালী হোক না কেন।
প্রায় অসম্ভব বিজয়কে ৩৬ দিনে ছিনিয়ে আনার যে বিরল কৃতিত্ব, তার একমাত্র দাবিদার বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রছাত্রীরা। অসীম সাহস ও বিরল বীরত্বের সঙ্গে গুলি উপেক্ষা করে নিশ্চিত মৃত্যু উপেক্ষা করে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে নিমেষেই ভস্ম করে উড়িয়ে দিয়েছে ক্ষমতার মসনদ, ধূলিসাৎ করে দিয়েছে দাম্ভিক অহংকার, ফুটো করে দিয়েছে মিথ্যার ফাঁপা বেলুন।
আন্দোলনের শেষাংশে যদিও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দলমত–নির্বিশেষে দেশের সর্বসাধারণ একাত্মতা প্রকাশ করে রাস্তায় নেমে আসে। কোটা সংস্কারের দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেতে থাকে লাশের সংখ্যা, যতই লাশের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে লাগল, দাবিরও পরিবর্তন হতে লাগল। বিশাল গণসমুদ্রে দাবি এসে শেষ পর্যন্ত ঠেকল এক দফায়। এক দিনের মধ্যেই এক দফার দফারফা হয়ে গেল। পদ্যতাগ করে ভারতে চলে যেতে হলো শেখ হাসিনাকে।
নতুন অধ্যায়ের সূচনা
স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক নিয়মে ক্ষমতার পরিবর্তন আর অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পরিবর্তনে তফাত রয়েছে। ঠিক যেমনটি হয় যুদ্ধ শেষে। কারণ, তখন ল অ্যান্ড অর্ডার সচল থাকে না, নেতৃত্বহীনভাবে কিছুদিন থাকে রাষ্ট্র। যাদের মাধ্যমে অভ্যুত্থান, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ মূলত তারাই নেয়। তাদের মধ্যেই কেউ কেউ দায়িত্ব নেয় রাষ্ট্র চালনার। যেহেতু অভ্যুত্থান করেছেন ছাত্ররা, সুতরাং তাঁদের অভিজ্ঞতা ও বয়স তাঁদের রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রতিবন্ধক। সে ক্ষেত্রে তাঁরাই রাষ্ট্রের মধ্য থেকে তাঁদের পছন্দমতো কতিপয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে অনুরোধক্রমে দায়িত্ব প্রদান করেন।
আন্দোলনের শুরুতে ছাত্ররা কি ভেবেছিলেন আন্দোলনটা সরকার পতনে গিয়ে ঠেকবে? আন্দোলনের শেষ দিনও কি নিশ্চিতভাবে ছাত্ররা জানতেন যে সেদিনই বিজয় আসবে? কে উপদেষ্টা হবেন আর কে হবেন না—ছাত্ররা আগে থেকে নির্ধারণ করে রাখেননি। সেভাবে যাচাই–বাছাই ও রিসার্চ করারও সুযোগ পাননি কাকে কাকে প্রস্তাব দেবেন। তৎক্ষণাৎ যাঁদের মনে হয়েছে দু-তিন দিনের মধ্যে তাঁদের একটি তালিকা করে নেন। এর মধ্যে হয়তো কিছু মানুষের উপদেশ তাঁরা গ্রহণ করেন। উপদেষ্টাদের কার্যক্রমেই বোঝা যাবে কাকে নেওয়া ভালো সিদ্ধান্ত হয়েছে, কাকে নয়। সময়ে সময়ে এর হালনাগাদ করতে পারবেন।
আসন্ন সমস্যাবলি
নতুন সরকার গঠিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু সমস্যার কি সমাধান হচ্ছে? হ্যাঁ হবে, তবে এক দিনে নয়, সময় লাগবে। সমস্যা আসবে বিভিন্ন দিক দিয়ে।
প্রথমত, সমস্যা আসবে সর্বশেষ সরকার দল ও তাদের অনুসারীদের থেকে। তারা বিভিন্নভাবে বিভিন্ন দিক দিয়ে সমস্যা তৈরির চেষ্টা করতে পারে। গত সরকার ইতিমধ্যে সমগ্র রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান তাদের করে নিয়েছে। সে প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত করতে সময় লাগবে, সে পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ সমস্যা তৈরি হওয়াটাই স্বাভাবিক। এ ছাড়া গত ১৫ বছরে তাদের অর্জিত শক্তি–সামর্থ্য প্রয়োগের যথাসাধ্য চেষ্টা করবে।
দ্বিতীয়ত, অন্য রাজনৈতিক দলগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে পারে ও স্বাভাবিক কাজে বাধা প্রদান করতে পারে। বিশেষ করে নির্বাচন দিতে বিলম্ব হলে তারাও আন্দোলনে নামতে পারে। ইতিমধ্যে দু–একটি দলের নেতা–কর্মীরা দখল, চাঁদাবাজিতে মত্ত হয়ে পড়েছেন, যদিও কেন্দ্রীয়ভাবে অনেক দল এসব থেকে বিরত থাকতে কড়াভাবে নিষেধ করেছে। সময়ের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থান পরিষ্কার হয়ে যাবে।
তৃতীয়ত, আন্দোলনকারীদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, দ্বিধাবিভক্তি, রেষারেষি শুরু হতে পারে। সমগ্র দেশে লাখো ছাত্রছাত্রী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তাঁদের শতাধিক সমন্বয়ক ছিলেন। আন্দোলনপূর্ব মুহূর্তে সবাই একটি লক্ষ্যে এগিয়েছিলেন, যার কারণে সমন্বয়ের অভাব হয়নি। কিন্তু আন্দোলন–পরবর্তী সময় ভিন্ন। এখন সিদ্ধান্তে পরিবর্তন আসবে, কার্যক্রমে পরিবর্তন আসবে এবং সেই সঙ্গে থাকবে মতানৈক্য ও মতভেদ এবং এটাই স্বাভাবিক। কৃতিত্ব, পদ ও প্রাপ্তির বিষয়গুলো জোরেশোরে উচ্চারিত হবে এবং তখন দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়।
চতুর্থত, এ ছাড়া ছাত্ররা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে পারেন বলে গুঞ্জন ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। যা হবে ছাত্রদের জন্য বড় রকমের চ্যালেঞ্জের বিষয়। যা নিয়ে নিজেদের মধ্যেও তৈরি হবে মতভেদ। কেউ কেউ প্রধান সমন্বয়কদের নির্দেশ পালনে অপারগতা প্রকাশ করবেন।
লাখো শিক্ষার্থীর মধ্যে কয়েকজনের কার্যক্রম কিছু অনৈতিক ও নিয়মবিরুদ্ধ হতে পারে এবং তা হওয়াটাই স্বাভাবিক। যার দায়ভার গিয়ে পড়বে সমগ্র ছাত্রসমাজের ওপর।
তা ছাড়া বিভিন্ন দল বা গোষ্ঠী ছাত্র আন্দোলনের প্রধান নেতাদের হাত করার চেষ্টা করবে। যার জন্য লোভনীয় বড় সব অফার দিতেও কার্পণ্য করবে না। কেউ কেউ হয়তো সে ফাঁদে পা দেবেন।
সর্বশেষ, দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। বিগত সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি দেশকে ভঙ্গুর অবস্থায় ফেলে গেছে। লাখো কোটির অধিক ঋণের বোঝা দেশের ঘাড়ে। সব প্রতিষ্ঠানের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে আছে। তারওউপর অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর রয়েছে রাজনৈতিক অবকাঠামো পরিবর্তনের গুরুদায়িত্ব।
সবকিছু একসঙ্গে সামাল দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে কাঠখড় পোড়াতে হবে এটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
ছোট মন্ত্রিপরিষদ ও পরিবর্তিত প্রশাসন নিয়ে সবকিছু নিয়ন্ত্রণে আনতে সময় তো লাগবেই। এ সময়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি কতটুকু নিয়ন্ত্রণে থাকবে, তা সময়ের সঙ্গে বোঝা যাবে। সবকিছু খুব অল্প সময়ে মসৃণভাবে চলবে এটা আমি অন্তত বিশ্বাস করি না। কারণ, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী সুপার হিউম্যান নন। দেশের বর্তমান পরিবেশ–পরিস্থিতি আমাদেরকে বুঝতে হবে এবং সে অনুযায়ী আমাদের প্রত্যাশা করতে হবে। সবকিছু গোড়া থেকে নতুন করে শুরু করতে হচ্ছে, সুতরাং ধৈর্য ধরার বিকল্প নেই।
শেষ কথা
দীর্ঘ সময় ধরে জেঁকে বসা স্বৈরতন্ত্রের বীজ বপন করা সাম্রাজ্যের পতন হলো। সেই সঙ্গে ভেঙে পড়ল ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা দুর্নীতির স্থাপনা। তা না হলে সময়ের সঙ্গে তা মহিরুহ আকার ধারণ করত, যা মোটেও সুখকর হতো না। যত দেরি হতো সমস্যা ততই জটিল আকার ধারণ করত। সে অবস্থা থেকে তো উত্তরণ ঘটল! এর মধ্যে থেকে কিছু পরিবর্তন তো আশা করাই যায়। বলছি না দুর্নীতি সমূলে উৎপাটিত হবে, কিন্তু দুর্নীতিই যেন রাজ না করে, সে অবস্থা তৈরি করার চেষ্টা তো করাই যায়। দেশকে গণতান্ত্রিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনাও হবে বড় ধরনের কৃতিত্ব।
এ আন্দোলন ছিল জনগণের আন্দোলন। আন্দোলনের প্রাক্বালে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল না, কিন্তু তারপরেও জনগণ তা হাসিমুখে বরণ করে নিয়েছিল। জনগণ আশা করি সবকিছু স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর আস্থা ও ধৈর্য রাখবে। সরকারকে সব ধরনের সমর্থন ও সহযোগিতা করে একটু সুস্থ পরিবেশ নিশ্চিতে এগিয়ে আসবে। তাহলে সব প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে একটি স্বপ্নের দেশের দেখা পাব
ছাত্রসমাজকেও ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। কে কী পেলেন, তার চিন্তা না করে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। স্যাক্রিফাইস করার মানসিকতা নিয়ে, দেশপ্রেম বুকে ধারণ করে এগিয়ে চললে কোনো সমস্যাই সমস্যা মনে হবে না।
একটি দেশপ্রেমিক, সৎ ও নিষ্ঠাবান সরকার এবং সুনাগরিকের গুণাবলিসম্পন্ন জনগোষ্ঠীই পারে একটি আদর্শ দেশ উপহার দিতে। এ আন্দোলনই যেন হয় বাংলাদেশের শেষ আন্দোলন।
লেখক: ওমর এফ নিউটন, আয়ারল্যান্ড