রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
● ২০২৯ সাল থেকে রূপপুরের ঋণের আসল শোধ শুরু হবে।
● প্রতিবছর প্রায় ৫০ কোটি ডলার দিতে হবে।

চীনা ঋণ
● চীনা ঋণও আটকে যাচ্ছে, গত এক বছরে কোনো ঋণচুক্তি হয়নি।
● ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ইউয়ানের ঋণ নিয়ে ‘ধীরে চলো নীতি’।

রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র | ফাইল ছবি

জাহাঙ্গীর শাহ: বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ কিছুটা কমাতে নতুন উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে রাশিয়ার কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধের সময় দুই বছর পিছিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের এই প্রস্তাবে ইতিমধ্যে রাশিয়ার সায় পাওয়া গেছে। কিস্তি পরিশোধ দুই বছর পেছালে সরকারের আপাতত প্রায় ৮০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

কর্মকর্তারা জানান, ইআরডি এখন আগের ঋণচুক্তি সংশোধনের কাজ করছে। ইতিমধ্যে একটি খসড়া চূড়ান্ত করে মতামতের জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কাছে পাঠিয়েছে ইআরডি।

এদিকে চীনের কাছ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা থেকে সরে দাঁড়াচ্ছে সরকার। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। চীনা মুদ্রা ইউয়ানে এই ঋণ নেওয়ার কথা ছিল।

ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, কোভিড এবং ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতি চাপে আছে। এই যুক্তিতে রূপপুর প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের আসল পরিশোধ পিছিয়ে দিতে চায় সরকার। অন্যদিকে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে চীনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার আগে যথাযথভাবে যাচাই–বাছাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, নীতিনির্ধারকদের কাছ থেকে এমন নির্দেশনা পেয়েছে ইআরডি।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের নির্বাহী পরিচালক (সানেম) সেলিম রায়হান বলেন, এখন বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ আছে। এই চাপ কমাতে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র নির্মাণের জন্য নেওয়া ঋণের আসল পরিশোধ পিছিয়ে দেওয়ার উদ্যোগটি ভালো। শুধু রূপপুর নয়; এমন অনেক প্রকল্পেই আসল পরিশোধ পিছিয়ে দেওয়ার জন্য দর-কষাকষি শুরু করা উচিত। এ জন্য একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠন করা দরকার।

বছরে পরিশোধ ৫০ কোটি ডলার
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য রাশিয়ার এক্সিম ব্যাংকের কাছ থেকে ১ হাজার ২৬৫ কোটি ডলার নিয়েছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে উভয় পক্ষের মধ্যে এই ঋণচুক্তি হয়। এই ঋণের অর্থ আসা শুরু হয় ২০১৭ সালে। ইতিমধ্যে ঋণের সুদ পরিশোধ শুরু হয়েছে। প্রতিবছর দুই কিস্তিতে ১১ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়; কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে মস্কোর ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা থাকায় রুশ এক্সিম ব্যাংকের কাছে এই অর্থ পাঠানো যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি বিশেষ হিসাবে এই অর্থ জমা হচ্ছে।

১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ড শেষে ২০২৭ সালের ১৫ মার্চ থেকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণের মূল কিস্তি (আসল পরিশোধ) শুরু হওয়ার কথা। প্রতিবছর ছয় মাস পরপর দুই কিস্তিতে মোট ৩৯ কোটি ডলার আসল পরিশোধ করতে হবে। এর সঙ্গে থাকবে ১১ কোটি ডলার সুদ। অবশ্য সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সুদ ও আসলের পরিমাণ কমবে বা বাড়বে।

জানা গেছে, কোভিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে অর্থনীতি চাপে আছে—এমন কারণ দেখিয়ে কয়েক মাস আগে দুই দেশের যৌথ কারিগরি কমিটির বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে রাশিয়ার ঋণের আসল পরিশোধ আরও দুই বছর পিছিয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। তাতে রাশিয়া রাজিও হয়। এখন দুই দেশের মধ্যকার ঋণচুক্তি সংশোধনের জন্য একটি খসড়া চূড়ান্ত করেছে ইআরডি। শিগগিরই এ–সংক্রান্ত প্রটোকলে সই করবে দুই দেশ।

ইআরডির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, ২০২৯ সালের ১৫ মার্চ থেকে ঋণের আসল পরিশোধ শুরু করার বিষয়ে রাজি আছে রাশিয়া। তবে এখনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কোডিড ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রকল্পের কাজে বিঘ্ন হয়েছে। তাই ঋণের আসল পরিশোধ দুই বছর পেছানোর বিষয়ে দুই দেশই একমত। এ জন্য শিগগিরই একটি প্রটোকলে সই হবে।

সব মিলিয়ে ১ লাখ ১৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকার এই প্রকল্প ২০২৫ সালের ৩১ ডিসেম্বরে শেষ হওয়ার কথা; কিন্তু নির্মাণকাজে বিলম্ব হওয়ায় প্রকল্প শেষ হতে আরও দুই বছর লাগবে। 

আটকে গেল চীনা ঋণ
গত এপ্রিল মাসে চীনা মুদ্রা ইউয়ানে ৫০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ ঋণ দেওয়ার প্রস্তাব দেয় বেইজিং। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে ভুগতে থাকা বাংলাদেশকে এই অর্থ বাণিজ্য সহায়তা (ট্রেড ফিন্যান্স) হিসেবে দিতে চেয়েছিল চীন। চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের মূল্য ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে পরিশোধের সুযোগ করে দেওয়াই ছিল এর উদ্দেশ্য; কিন্তু সাবেক সরকার এই প্রস্তাবে পুরোপুরি রাজি হয়নি। অর্ধেক অর্থ বাজেট–সহায়তা, আর বাকিটা ট্রেড ফিন্যান্সের আওতায় নিতে চেয়েছিল বাংলাদেশ।

সদ্য ক্ষমতা হারানো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত জুলাই মাসে যখন চীন সফর করেন, তখন দুই দেশ এ বিষয়ে একমত হতে পারেনি। ফলে ওই সফরের সময় কোনো চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়নি। পরে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।

গত সপ্তাহে ইআরডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। বৈঠকে চীনসহ অন্যান্য দেশ থেকে পাওয়া দ্বিপক্ষীয় ঋণের প্রস্তাব যাচাই–বাছাই করে চূড়ান্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। গত এক বছরের বেশি সময় চীনের সঙ্গে নতুন কোনো ঋণচুক্তি হয়নি। এ সময়ে চীনের কাছ থেকে নতুন ঋণের কোনো প্রতিশ্রুতিও আসেনি।