চারদিকে শুধু পানি, বাড়ির পর বাড়ি খালি

বন্যার পানি বেড়ে যাওয়ায় নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে মানুষজনকে। আজ বিকেলে ফেনীর ভাঙ্গা তাকিয়া এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি ফেনী: ফেনী সদর উপজেলার লেমুয়া টঙ্গির পাড়া এলাকা দিয়ে ঢুকতেই দেখা গেল, বাড়িঘর সব পানির নিচে। কোনো কোনো ভবনের একতলার পুরোটাই তলিয়ে গেছে। এসব বাড়িতে কোনো মানুষ নেই। তালাবদ্ধ করে নিরাপদ স্থানে চলে গেছেন সবাই। আজ বৃহস্পতিবার বিকেল পাঁচটায় এ চিত্র দেখা গেছে।

সরেজমিনে দেখা যায়, ওই এলাকার অধিকাংশ ঘরবাড়ি খাঁ খাঁ করছে। কাঁচা–পাকা কিছু ঘর ভেঙে পড়েছে।

ভারী বর্ষণ ও ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলে ফেনীর মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর পানি বিপৎসীমার অনেক ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নদীর পানি উপচে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। চার দিন ধরে বন্যা হলেও তেজ বাড়তে থাকে গতকাল বুধবার। পানির প্রবল স্রোত সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বেশির ভাগ এলাকায় বিদ্যুৎ নেই।

লেমুয়া নদীর আশপাশের যেসব বাসিন্দা, তারা গতকাল সন্ধ্যায় চলে গেছে। আজ পাঁচটায় নদীর পাশের এলাকায় গিয়ে কথা হয় সাত্তার মিয়ার সঙ্গে। বন্যা পরিস্থিতির বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। বাড়িঘর ফাঁকা হয়ে গেছে। সবাই যে যাঁর মতো করে নিরাপদে সরে গেছেন। দু-একজন বয়োজ্যেষ্ঠ ঘরবাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য থাকার চেষ্টা করছেন। কিন্তু পানির এত স্রোত সেটিও সম্ভব হবে না।’

আজ ফেনী সদরের কালীদহ, বালিগাঁও, লেমুয়া, ছনুয়া ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম স্থানীয়দের সহযোগিতায় ঘুরে দেখেন এই প্রতিবেদক। জনমানবহীন এসব গ্রামে শুধু পানি আর পানি। দু-একজনকে দেখা গেলেও তাঁরা কেউ মিরসরাই, কেউ চট্টগ্রাম শহরে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

নাসরিন আক্তার নামের লেমুয়া ইউনিয়নের এক নারীকে দেখা গেল, কলাগাছ, বাঁশ ও লাঠি দিয়ে ভেলা বানিয়ে ভাসছিলেন। তিনি জানান, তার টিনের ঘরটি ডুবে গেছে। একটি ছাগল ও তিনটি হাঁস ভেসে গেছে। একমাত্র মেয়েকে ছয় মাসের বাচ্চাসহ বারইয়ারহাট পাঠিয়েছেন।

শেখ রফিকুল ইসলামের বাড়ি ঘোপাল ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামে। তাঁর একতলা বাড়ি ডুবে গেলেও ছাদের ওপর থাকার বন্দোবস্ত করেছেন। ত্রিপল টাঙিয়ে থাকবেন। তিনি জানান, আশপাশের কেউ বাড়িতে নেই। কিন্তু তাঁরা পুরুষ কয়েকজন রাতে ছাদের ওপর থাকবেন।

শেখ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যা সবকিছু শেষ করে দিল। দুটি পুকুরে দেড় লাখ টাকার মাছের পোনা ছেড়েছিলাম। রুই, কাতল, তেলাপিয়াসহ বিভিন্ন জাতের মাছ ছিল। কিন্তু পানি সব ভাসিয়ে নিল।’

ছাগলনাইয়ার দক্ষিণ মন্দিয়া পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলমের বাড়ির পুরোটাই ডুবে গেছে। তিনি মেয়েকে কোলে নিয়ে কোনো রকমে সড়কে পৌঁছান। পরিবারের বাকি তিন সদস্য আটকে আছেন।

চট্টগ্রাম-ঢাকা মহসড়কও এখন পানিতে একাকার। দূর থেকে তাকালে মনে হবে, কোনো নদী বয়ে চলেছে। এই প্রসঙ্গ টেনে শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, ১৯৮৮ সালে যে বন্যা হয়েছিল, তখনো এত পানি সড়কে আসেনি। তলিয়ে যায়নি দোতলা ভবন। কিন্তু এবার হলো।

ট্রাকে-বাসে বন্যাকবলিত মানুষ
আজ শত শত বন্যাকবলিত মানুষ বাসে, ট্রাকে, মিনিবাসে চড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাচ্ছিলেন। মহাসড়কে থেকে এ দৃশ্য দেখা গেছে।

একটি মিনিবাসে ফেনী সদরের দিকে যাচ্ছিলেন ২১ জন নারী, পুরুষ ও শিশু। তাঁদের মধ্যে কামরুন নাহার বলেন, তাঁদের বাড়ি পূর্ব সিলোনিয়া গ্রামে। সবাই বাস্তুহারা হয়ে গেছেন। কিছু কাপড় ও চাল নিয়ে ফেনী সদর যাচ্ছেন।

কামরুন নাহার বলেন, ‘পানি নেমে গেলে কী হবে, কে জানে। কোনো কিছুই আর অবশিষ্ট নাই। পানিতে সবজির খেত শেষ হয়ে গেছে। একটা ছাগল বাঁচাতে পেরেছেন। হাঁসগুলো ভেসে গেছে। ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে কত দিন লাগে, সেটা জানি না।’

ট্রাকে ওঠার সময় কথা হয় হান্নান মিয়ার সঙ্গে। তাঁর শ্যালিকা স্থানীয় কালির বাজার এলাকায় থাকেন। কিন্তু খোঁজ পাচ্ছেন না সকাল থেকে। তাই এসেছিলেন। কিন্তু পানির জন্য যেতে পারেননি।

যানবাহন চলছে ধীরগতিতে
মহাসড়কের ফেনী অংশে যানবাহন চলছে অনেকটা ধীরগতিতে। কেউ তিন ঘণ্টা, কেউ চার ঘণ্টা ধরে বাসে, ট্রাকে, কারে বসে ছিলেন।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফেনী সদরের লালপোল এলাকায় পানির প্রবল স্রোত বয়ে যাচ্ছে। বুকসমান পানি জমে গেছে। এ কারণে যানবাহন চলাচল করতে পারছে না।

চট্টগ্রাম থেকে নোয়াখালীতে যাওয়ার জন্য বাসে উঠিলেন আরশাদুল আলম। প্রায় দুই ঘণ্টা পর এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, তাঁর বাড়িতেও পানি ঢুকে গেছে। তাই যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথে আটকে গেলেন।