হামলার পর আতঙ্কে আছেন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাহাড়িয়া পল্লির মেয়েরা

সরকার পতনের দিন রাজশাহীর মোহনপুরে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের ঘরবাড়িতে হামলা হয়। শনিবার দুপুরে মোহনপুরের পিয়ারপুর গ্রামের পাহাড়িয়া পল্লিতে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

মোহনপুর রাজশাহী: ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর রাজশাহীর মোহনপুর উপজেলার পিয়ারপুর গ্রামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী পাহাড়িয়া সম্প্রদায়ের পল্লিতে হামলার ঘটনা ঘটে। হামলা থেকে বাঁচতে নদে ঝাঁপ দিয়েছেন মেয়েরা। ছেলেরা দৌড়ে পালিয়ে জীবন বাঁচান। হামলাকারীরা বাড়িঘর ভাঙচুর করে লুটপাট করেছেন বলে অভিযোগ।

ভুক্তভোগীরা বাড়িতে ফিরে দেখেন, অনেকের ঘরের চালা ভেঙে ফেলা হয়েছে। আগুন দেওয়া হয়েছে তিনটি বাড়িতে। টিনের ভাঙা চালার ওপর এখন পলিথিনের ছাউনি দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় আতঙ্কে রাতে ঘুমাতে পারছেন না নারীরা। শিব নদের পাড়ের এ সম্প্রদায়ের মানুষেরা এখনো ঠিকমতো রান্না-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে পারেননি। আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত প্রশাসনের কেউ তাঁদের খোঁজ নেননি।

আজ দুপুরে ওই পল্লিতে গিয়ে দেখা যায়, ভাঙা চালা পলিথিন দিয়ে ঢেকেছেন। বেড়াগুলো এখনো ভাঙা। বাড়ির বিদ্যুৎ–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে সংযোগ নেওয়ার ব্যবস্থা করছেন। নিমাই সিংহের শোবার ঘর ও রান্নাঘরে আগুন দেওয়া হয়েছিল। উঠানে টিনের চালার মন্দিরও ভাঙা হয়েছে। শোবার ঘরের সব জিনিসপত্র পুড়ে গেছে। মিটার ছাড়া ভেতরের সবকিছু পুড়ে গিয়েছিল। মিস্ত্রি ডেকে ঠিক করাচ্ছেন।

নিমাইয়ের স্ত্রী রীতা সিংহ বলেন, মাঠ থেকে কাজ করে এসে ভাত খেয়ে উঠেছেন। থালায় পানি ঢালতে পারেননি। তাঁর ছেলে ভাতের থালা ফেলেই দৌড় দিয়ে পালিয়েছেন। দুই দিন হচ্ছে তাঁরা বাড়িতে ফিরেছেন। এই পল্লির প্রায় ২০টি পরিবারের কমবেশি একই অবস্থা।

নিপেনের স্ত্রী সূর্যি রানী চোখ মুছতে মুছতে বলেন, ‘নদের জলেই ঝাঁপ দিয়েছিলাম আমি আর আমার মেয়ে। আমার স্বামীও দেখছি জলে। আমরা তিনজন তিন ঘণ্টা জলেই ছিলাম। তা ছাড়া আমাদের কাইটতক। উঠতে দেখছি, আবার হাইস্যা লিয়্যা তাইড়্যা আসছে। এভাবে কী মানুষ বাস কইরতে পারে?’ তাঁর অভিযোগ, হামলাকারীরা যাঁদের বাড়িতে যুবতী মেয়ে আছে, তাঁদের নাম ধরে ধরে বলেছে, ‘উমুকের বাড়িতে চল।’

লাবনী রানী সিংহ বলেন, ‘গ্রামের নেতারা হাইস্যা লিয়্যা তাইড়্যা আসছে দেখে আমরা ছয়টা মেয়ে শিব নদের জলে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আমার ছোট বোনটা সাঁতার জানে না। সে ডুবে মইরে যাচ্ছিল। আমার এক নানা এসে তাকে টেনে তুলেছে। গিরামের এক পাশে গিয়ে পালাইয়েছিলাম।’ পাশে দাঁড়ানো মেয়েদের দেখিয়ে বলেন, ‘এসব বিটি ছাওয়ালগুলো রাতে ঘুমাইত পারে না। এখনো ভয় করে কখন হাইস্যা লিয়্যা তাইড়্যা আসবে।’

সুলেখা সিংহ বলেন, ঘটনার দিন তিনি মাঠ থেকে ফিরে খাওয়াদাওয়া করে দেশের অবস্থা কী জানতে টিভি দেখতে যাচ্ছিলেন। তখন হামলা হয়। তিনি স্বামী-সন্তান নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে জীবন বাঁচান। হামলাকারীরা চলে যাওয়ার পর ফিরে এসে দেখেন, ঘরের বেড়া, চালা ও পানির মোটর সব ভেঙে দিয়েছে। বাইরের বেড়াগুলো ঠিক করলেও এখনো চালা ঠিক করতে পারেননি।

ধীরেন সিংহের মেয়ে মুক্তি রানী বলেন, তাঁর মা বাড়িতে ছিলেন না। আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলেন। তাঁর সন্তানসহ তাঁরা ছয়জন বাড়িতে ছিলেন। খাওয়াদাওয়া করে সবাই বিশ্রাম নিতে যাচ্ছেন। এ সময় মানুষের চিৎকার শুনে বাইরে গিয়ে দেখেন, একদল মানুষ লাঠিসোঁটা নিয়ে এগিয়ে আসছে। তিনি সবাইকে ডেকে দিয়ে শিব নদের ওপারে যান। তাঁর মনে হয়েছিল, বাড়িতে পেলে সবাইকে মেরে ফেলত।

পাহাড়িয়া পল্লির মধুমালা সিংহ বলেন, ‘আমরা আদিবাসী। আমরা নরম কাদার মতো। আমাদের যেদিকে কাত করবে, সেদিকে কাত হব। আমাদের মতো গরিব মানুষকে মাইরবেন কেন?’

জানতে চাইলে মোহনপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আয়শা সিদ্দিকা বলেন, মিনিট ১৫ আগে একজন সাংবাদিকের কাছ থেকে তিনি ঘটনাটি শুনেছেন। তার আগে কেউ তাঁকে জানাননি। গত শুক্রবার উপজেলার রাজনৈতিক নেতা, থানার ওসি, সেনা কর্মকর্তা ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোকজন নিয়ে মতবিনিময় সভা করেছেন। সেখানেও কেউ বিষয়টি তোলেননি। তিনি ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর নিরাপত্তার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করার আশ্বাস দেন।