কিয়েভে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে স্বাগত জানান ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি | ছবি: রয়টার্স

পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইউক্রেন সফরে গিয়েছেন। বৈঠক করেছেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে। কয়েক সপ্তাহ আগে মোদি মস্কোয় গিয়ে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও বৈঠক করেন।

মোদির কিয়েভ সফর বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, গত জুলাইয়ে তিনি যখন রাশিয়ার রাজধানী মস্কোয় যান, তখন ইউক্রেন এবং পশ্চিমা কয়েকটি দেশ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল।

সমালোচনা করে জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশের নেতা মস্কোয় গিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে রক্তাক্ত অপরাধীকে আলিঙ্গন করছেন, এটা আমাকে হতাশ করেছে।’

তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে, নরেন্দ্র মোদি কি জেলেনস্কি ও পশ্চিমা নেতাদের শান্ত করার জন্য কিয়েভ সফরে গেছেন?

হয়তো পুরোপুরি এমনটা নয়।

দুটি পরস্পরবিরোধী দেশ কিংবা বলয়ের সঙ্গে সম্পর্কে ভারসাম্য রেখে চলার ঘটনা ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে নতুন নয়। দশকের পর দশক ধরে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে জোটনিরপেক্ষ অবস্থান নিয়ে রেখেছে দিল্লি।

গতকাল শুক্রবার মোদির কিয়েভ সফরের মধ্য দিয়ে এবারই প্রথম কোনো ভারতীয় সরকারপ্রধান ইউক্রেনে রাষ্ট্রীয় সফরে গেলেন। মস্কোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে এগিয়ে নেবে দিল্লি, এমন ইঙ্গিতের চেয়েও এটা বেশি কিছু। যদিও পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গেও নরেন্দ্র মোদির ভারত ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক চিন্তক প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, এ সফর ভারতের কৌশলগত স্বাধীনতাকে আরও জোরালো করবে।

কুগেলম্যান আরও বলেন, পশ্চিমা শক্তিকে খুশি করায় নিয়োজিত নয় ভারত। এটা কিয়েভের সঙ্গে বন্ধুত্ব পুনরুদ্ধার ও চলমান যুদ্ধের বিষয়ে ক্রমাগত উদ্বেগ প্রকাশ, ভারতীয় স্বার্থ এগিয়ে নেওয়ার সফর।

যদিও মোদির কিয়েভ সফরের এই সময়কাল বুঝিয়ে দিচ্ছে, ভারতীয় কূটনীতিকেরা মোদির মস্কো সফরের সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনাকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন।

এর আগে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে মস্কোর সরাসরি সমালোচনা করা থেকে বিরত ছিল দিল্লি। ভারতের এমন অবস্থান পশ্চিমা শক্তিগুলোর বিরক্তির কারণ হয়েছিল।

তবে ভারত সব সময় ভৌগোলিক অখণ্ডতার প্রতি শ্রদ্ধা দেখানোর গুরুত্বের কথা বলে এসেছে। সেই সঙ্গে ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে কূটনীতি ও সংলাপের জন্য ক্রমাগতভাবে চাপ দিয়ে এসেছে।

মোদি গত জুলাইয়ে যখন মস্কো যান, তাঁর কয়েক ঘণ্টা আগে ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে অন্তত ৪১ জনকে হত্যা করে রুশ বাহিনী। ওই সময় কিয়েভে একটি শিশু হাসপাতালে হামলা চালানো হয়। এতে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানায় পুরো বিশ্ব।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, হামলায় শিশুর মৃত্যু খুবই দুঃখজনক ও ভয়ংকর ঘটনা। তবে এ হামলার জন্য রাশিয়াকে দোষারোপ করেনি ভারত।

ভারত–রাশিয়া সম্পর্ক
কিয়েভ সফরে গিয়ে নরেন্দ্র মোদির ভারত এই নীতি থেকে বেরিয়ে আসবে, এটা আশা করা যায় না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা দিল্লির এমন অবস্থান অনেকটাই মেনে নিয়েছে। কারণ, মস্কো–দিল্লির মধ্যে দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত বন্ধুত্ব রয়েছে। সেই সঙ্গে রুশ সামরিক উপকরণের ওপরও ভারত নির্ভরশীল। 

ভারত বিশ্বের শীর্ষ অস্ত্র আমদানিকারক দেশ। দেশটি সাম্প্রতিক সময় অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানির উৎসে বেশ বৈচিত্র্য এনেছে। নিজস্ব উৎপাদনও বাড়িয়েছে। এত কিছুর পরও ভারতের অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম আমদানির ৫০ শতাংশের বেশি এখনো রাশিয়া থেকেই আসে।

রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল আমদানি বাড়িয়েছে ভারত। গত বছরও ভারতের বাজারে সবচেয়ে বেশি তেল রপ্তানিকারক দেশ ছিল রাশিয়া। মূলত সস্তা দামের সুযোগ কাজে লাগিয়ে রাশিয়া থেকে বেশি বেশি তেল কিনছে দিল্লি।

যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে দিল্লিকে বারবার নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করার অনুরোধ করেছে। দিল্লি আগ্রহ না দেখালেও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ কিংবা চাপ প্রয়োগ করতে দেখা যায়নি।

পশ্চিমাদের চোখে, শক্তিসাম্যের রাজনীতিতে চীনের বিপরীতে ভারসাম্য আনে ভারত। তাই এই অবস্থানকে বিচলিত করতে চায় না পশ্চিমারা। এ ছাড়া ভারত বর্তমানে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি। ব্যবসার জন্য ক্রমবর্ধমান একটি বাজার।

মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, পশ্চিমারা মোদির কিয়েভ সফরকে স্বাগত জানিয়েছে। ভালো চোখে দেখছে। তারা এই সফরকে সব পক্ষের সঙ্গে দিল্লির স্বেচ্ছায় যুক্ত হওয়া হিসেবে দেখতে চাইছে।

এটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কেননা, ভারত পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক এগিয়ে নিতে আগ্রহী। সম্পর্কের অগ্রগতিকে কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করতে চায় না। ভারতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি সম্প্রতি বলেন, এটাকে ‘নিছকই সম্পর্ক রক্ষার জন্য সম্পর্ক’ হিসেবে দেখা উচিত হবে না।

প্রসঙ্গ যখন চীন
আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের সঙ্গে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে রাশিয়া। এ জন্যও পশ্চিমাদের প্রয়োজন ভারতের।

বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধে নরেন্দ্র মোদি নিজেও একজন শান্তি স্থাপনকারী হিসেবে ভূমিকা রাখতে পারেন। কেননা, পশ্চিমা দেশগুলো ও রাশিয়া—উভয়ের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তবে মোদি কোনো শান্তি পরিকল্পনা সামনে আনবেন, এমনটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।

এ বিষয়ে মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, ‘আমি মনে করি না যে রাশিয়া ও ইউক্রেন রাজি না হওয়া পর্যন্ত মোদি শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করতে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পরিকল্পনা হাজির করবেন। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয়, তারা রাজি হবে না।’

ভারতের মধ্যস্থতার উদ্যোগ না নেওয়ার বিষয়ে আরেকটি কারণ উল্লেখ করেন কুগেলম্যান। সেটি হলো, এসব বিষয় অভ্যন্তরীণ ইস্যু হিসেবে দেখতে চায় ভারত। যেমনটা কাশ্মীর নিয়ে এমন কোনো পদক্ষেপ পছন্দ করে না দিল্লি।

এদিকে মোদির কিয়েভ সফরকে খোলামনে স্বাগত জানিয়েছে জেলেনস্কি প্রশাসন। ইউক্রেন এ সফরকে মস্কোর একটি ঘনিষ্ঠ মিত্রের কাছাকাছি আসার সুযোগ হিসেবে দেখছে। যুদ্ধ শুরুর পর এমন সুযোগ খুব কমই এসেছে।

মোদির সামনে পুতিনের তুমুল সমালোচনা করতে পারেন জেলেনস্কি। এর আগেও বিভিন্ন পশ্চিমা রাজধানীতে মোদি এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছেন।

অন্যদিকে রাশিয়াও এ সফর নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো থেকে বিরত থাকবে। কেননা, এটাকে ভূরাজনীতিতে ভারতের বহুপক্ষীয় কৌশল হিসেবে দেখা হবে। তবে এটা ঠিক, জোটনিরপেক্ষ নীতি পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি এ সফরে ভারতের আরও বড় কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে।

ইউরোপের সঙ্গে সুসম্পর্ক
গত এক দশকে ইউরোপের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে ভারত। বিশেষ করে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের তুলনামূলক অনুন্নত দেশগুলোর সঙ্গে। এ ছাড়া ইউরোপের বৃহত্তম চার শক্তির (যুক্তরাজ্য, ইতালি, জার্মানি ও ফ্রান্স) সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে চায় ভারত। সুসম্পর্ক গড়তে চায় ইউরোপের অন্যান্য দেশের সঙ্গেও।

এ সফরেই ইউক্রেনের আগে পোল্যান্ডে গেছেন নরেন্দ্র মোদি। ৪৫ বছরের মধ্যে তিনিই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী, যিনি দেশটিতে সফরে গেলেন। গত জুলাইয়ে অস্ট্রিয়ায় গিয়েছিলেন মোদি। ৪১ বছরের মধ্যে প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি দেশটি সফরে যান।

বিশ্লেষকদের মতে, মোদির নেতৃত্বধীন ভারত মনে করছে, আগামীর ভূরাজনীতিতে মধ্য ইউরোপের দেশগুলো বড় ভূমিকা রাখবে। আর এসব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক আখেরে দিল্লির জন্য লাভজনক হবে।

তাই বলা যায়, মোদির কিয়েভ সফরে মনোযোগের কেন্দ্রে শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ থাকবে না; বরং আরও বড় উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি সফরে গেছেন।