বাংলার দুঃখ ফারাক্কা বাঁধ

ফারাক্কা বাঁধ | ছবি: সংগৃহীত

নূহু আব্দুল্লাহ: সিলেটের বন্যার জন্য দায়ী বাংলাদেশের দুঃখ নামে পরিচিত ফারাক্কা বাঁধ চাপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর অবস্থিত। ১৯৬১ সালে গঙ্গা নদীর ওপর এই বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হয়। নির্মাণ সম্পন্ন হয় ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বরে। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল বাঁধটি চালু হয়।

ফারাক্কা বাঁধের দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ২৪ কিলোমিটার বা ৭ হাজার ৩শ ফুট। এটি শুধু একটি বাঁধ নয়, এই অবকাঠামোটি একটি সড়ক ও রেলসেতু হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।

বাঁধটিতে মোট ১০৯টি গেট রয়েছে। ফারাক্কা সুপার তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রে পানি এই বাঁধ থেকেই সরবরাহ করা হয়। এই বাঁধের উপর দিয়ে গিয়েছে ৩৪নং জাতীয় সড়ক ও রেলপথ। যা কেবল উত্তরবঙ্গ ও দক্ষিণবঙ্গকেই নয়, ভারতের উত্তর-পূর্ব অংশকে বাকি ভারতের সঙ্গে জুড়ে রাখতে বড় ভূমিকা পালন করে। এই বাঁধের মূখ্য উদ্দেশ্য ছিল পানির অভাবে হারিয়ে যেতে বসা গঙ্গার শাখানদী ভাগীরথীকে পুনরায় গঙ্গার পানিতে পুষ্ট করে, দিন দিন নাব্যতা হারিয়ে ফেলা কলকাতা বন্দরকে আগের রূপে ফিরিয়ে এনে কার্যক্ষম করে তোলা।

১৯৫০ ও ৬০-এর দশকে কলকাতা বন্দরের কাছে হুগলি নদীর পলি ধুয়ে পরিস্কার করার জন্য ফারাক্কা বাঁধ তৈরি করা হয়। শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারি থেকে জুন) ফারাক্কা বাঁধ গঙ্গার ৪০,০০০ ঘনফুট/সে পানি হুগলি নদীর দিকে চালিত করে। তৎকালীন হিন্দুস্তান কনস্ট্রাকশন কোম্পানি প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে তৎকালীন সোভিয়েন ইউনিয়নের সহায়তায় বাঁধটি তৈরি করে।

তৎকালীন বিভিন্ন সমীক্ষায় বিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেন যে গঙ্গা/পদ্মার মত বিশাল নদীর গতি বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে নষ্ট হতে পারে। এ ধরনের নেতিবাচক অভিমত সত্ত্বেও ভারত সরকার ফারাক্কায় গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও হুগলী-ভাগরথীতে সংযোগ দেওয়ার জন্য ফিডার খাল খননের পরিকল্পনায় কাজ শুরু করে। পরবর্তীতে যা মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে।

১৮৫১ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল অবধি কমপক্ষে পাঁচটি সমীক্ষা করা হয়েছে কীভাবে গঙ্গার পানির এক অংশ ঘুরিয়ে হুগলী-ভাগরথীতে প্রবাহিত করে পলি অপসারণ করা যায়।

তৎকালীন ভারতের পশ্চিম বঙ্গের তদানীন্তন চীফ ইঞ্জিনিয়ার শ্রী কপিল ভট্টাচার্য এই পরিকল্পনার বিরোধিতা করে নিম্নরূপ অভিমত প্রকাশ করেন:

⚫গঙ্গা থেকে অপসারিত ৪০ হাজার কিউসেক পানি ফিডার খাল কিম্বা হুগলী-ভাগরথী ধারণ করতে পারবে না।

⚫গঙ্গা এবং ভাগরথীর প্রবাহ রেখার উচ্চতার তারতম্যের কারণে পানি সঞ্চালন কষ্টকর হবে। ফলে গঙ্গা নদী তার স্বাভাবিক প্রবাহের জন্য অন্য পথ খুঁজবে।

⚫প্রথমোক্ত কারণের জন্য মুর্শিদাবাদ এবং মালদা জেলা জুড়ে দেখা দিবে জলাবদ্ধতা।

⚫ব্রক্ষপুত্রের তুলনায় গঙ্গা কম গতি শক্তি সম্পন্ন নদী। এ ধরনের নদীর গতিপথ হয় আঁকা-বাঁকা (meandering)। এক বাঁক থেকে আরেক বাঁকের দূরত্বকে বলে মিয়ান্ডার দৈর্ঘ্য এবং একটি নির্দিষ্ট দূরত্বের মধ্যে কয়টা বাঁক রয়েছে তাকে বলে মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সি। হঠাৎ করে মৃতপ্রায় হুগলী-ভাগরথীর মধ্য দিয়ে কৃত্রিমভাবে বিপুল পরিমাণে পানি প্রবাহিত করলে হুগলী-ভাগরথী ও উজানে বিহার অবধি সব নদীর মিয়ান্ডার ফ্রিকোয়েন্সির উপর বিরূপ প্রভাব পড়বে। ফলে ঐ সমস্ত নদীতে জলাবদ্ধতা, নদী ভাঙ্গন এবং চর সৃষ্টি তরান্বিত হবে।

⚫ ভাটি অঞ্চলের সকল নদীর নাব্যতা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে।

⚫শুষ্ক মওসুমে পানি প্রবাহ কম হওয়ার কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন দেখা দিবে।

গঙ্গা নদীর পানি ভারতের একতরফাভাবে সরানোর কারণে শুধু যে বাংলাদেশের পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়। বরং এর ফলে বাংলাদেশের কৃষি, শিল্প, বন ও নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। এ বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২৯ অক্টোবর, ১৯৫১ সালে। তখন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার গ্রীষ্মকালে গঙ্গা নদী থেকে বিপুল পরিমাণ পানি পশ্চিমবঙ্গের ভাগীরথী নদী পুনরুজ্জীবিত করার জন্য অপসারণ করার ভারতীয় পরিকল্পনার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভারত জবাব দেয় তাদের এই পরিকল্পনা প্রাথমিক পর্যায়ে আছে এবং এর ফলাফল সম্পর্কে পাকিস্তানি উদ্বেগ কেবল তত্ত্বীয় ব্যাপার।

১৯৭০ সাল পর্যন্ত ভারত-পাকিস্তান এই বিষয় নিয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক আলোচনা করে। গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে লম্বা আলাপ-আলোচনার সে সময় জন্ম হয়।  কিন্তু এই আলোচনা যখন চলছিল তখন ভারত ফারাক্কা বাঁধের নির্মাণ কাজ অব্যহত রাখে এবং ১৯৭০ সালে এর কাজ শেষ করে।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের বহুল আলোচিত বিষয় এই ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গঙ্গার পানিবন্টন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালের ১৬ মে বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানিবন্টন বিষয়ে এক যৌথ বিবৃতি দেন। এই সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়, উভয় দেশ একটি চুক্তিতে আসার আগে ভারত ফারাক্কা বাঁধ চালু করবে না।

বাঁধের একটি অংশ পরীক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৫ সালে ভারতকে মাত্র ১০ দিনের (২১ এপ্রিল ১৯৭৫ থেকে ২১ মে ১৯৭৫) জন্য গঙ্গা নদীর ৩১০ থেকে ৪৫০ কিউসেক পানি অপসারণ করার অনুমতি দেয়। কিন্তু মুজিবুর রহমান হত্যার পর ভারত কোনোরকম আলোচনায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। ১৯৭৬ সালের শুষ্ক মৌসুম পর্যন্ত গঙ্গা নদী থেকে ১১৩০ কিউসেক পানি অপসারণ করে পশ্চিমবঙ্গের ভাগরথি-হুগলি নদীতে প্রবাহিত করে। ভারতকে পানি অপসারণে বিরত রাখতে ব্যর্থ হয়ে, বাংলাদেশ এই বিষয়টি জাতিসংঘে উপস্থাপন করে। বাংলাদেশের সঙ্গে করা ভারতের এ ধরনের অন্যায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে আলোচনা করা হলেও বিষয়টি ভারত খুব একটা পরোয়া করেনি।

২৬ নভেম্বর ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ভারতকে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়টি সুরাহার করার নির্দেশ দিয়ে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে। এরপর কয়েকবার বৈঠকের পর উভয় দেশ ৫ নভেম্বর ১৯৭৭ সালে একটি চুক্তি করে। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ও ভারত পরবর্তী পাঁচ বছরের (১৯৭৮-৮২) জন্য শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি ভাগ করে নেবে। ১৯৮২ এর অক্টোবরে উভয় দেশ ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে পানি বণ্টনের একটি চুক্তি করে। নভেম্বর ১৯৮৫ সালে আরও তিন (১৯৮৬-৮৮) বছরের জন্য পানি বণ্টনের চুক্তি হয়। এই পানিবন্টন চুক্তির কোনোটি ঠিকমতো মানেনি ভারত।

১৯৮৯ সালের শুষ্ক মৌসুম থেকে ভারত একতরফা প্রচুর পরিমাণ পানি গঙ্গা থেকে সরিয়ে নেয়। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশের নদ-নদীতে পানি প্রবাহের চরম অবনতি ঘটে।

১৯৯২ সালের মে মাসে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর এক বৈঠকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরসিমা রাও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে এই আশ্বাস দিয়েছিলেন যে, ভারত বাংলাদেশকে সমান পরিমাণ পানি দেওয়ার ব্যাপারে সম্ভাব্য সব কিছু করবে। ফলে এরপর দুই দেশের মধ্যে কোনো মন্ত্রী বা সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়নি।

১৯৯৩ সালের মার্চ মাসে বাংলাদেশের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অঞ্চলে মাত্র ২৬১ কিউসেক পানি প্রবাহ রেকর্ড করা হয়, যেখানে ফারাক্কা-পূর্ব সময়ে একই অঞ্চলে ১৯৮০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হতো। ১৯৯৩ সালের মে মাসে যখন উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রীরা আবার মিলিত হন, তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশেকে দেওয়া তার কথা রাখতে ব্যর্থ হন। একটি দীর্ঘ চুক্তির অভাবে বাংলাদেশ তার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য গঙ্গার পানি ব্যবহারে কোনো দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে পারেনি।

অবশেষে ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মেয়ে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নত হয়। ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর মাসে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী দেব গৌড় এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

নদী বা কোনো জলরাশির পানি পরিমাপের একক হলো, কিউবিক ফিট পার সেকেন্ড বা কিউসেক। ভারত-বাংলাদেশ চুক্তি অনুযায়ী নদীতে ৭০ হাজার কিউসেক পানি থাকলে উভয় দেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক। আর ৭৫ হাজার কিউসেকের বেশি পানি থাকলে ৪০ হাজার কিউসেক পাবে ভারত, বাকিটা পাবে বাংলাদেশ।

অথচ ভারতের খেয়ালখুশি মতো বাঁধ থেকে অনিয়ন্ত্রিভাবে পানি অপসারণ ও বন্ধের ফলে শুষ্ক মৌসুমে তীব্র পানি সংকট ও বর্ষা মৌসুমে প্রবল বন্যার কবলে পড়ছে বাংলাদেশ। ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা চুক্তিতে পানি বন্টনের বিষয়টি স্পষ্ট করে বলা থাকলেও সেটি ঠিকমতো মানছে না ভারত। প্রতিটি চুক্তির পর ভারত অন্যায়ভাবে চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করেছে।

ফারাক্কা বাঁধকেন্দ্রিক এই স্বেচ্ছাচারিতার ফলে শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারত নিজেও মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগে দেশের নদী বিশেষজ্ঞরা এর বিরোধীতা করেছিলেন। তারা বলেন, ‘গঙ্গা বা পদ্মার মতো বিশাল নদীর গতিপথে বাঁধ দিয়ে বিঘ্নিত করলে নদীর উজান এবং ভাটি উভয় অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এরপরও ভারত সরকার গঙ্গায় বাঁধ নির্মাণ এবং হুগলি ও ভাগিরথী নদীতে পানি পৌঁছানোর জন্য ফিডার খাল খননের কাজ শুরু করে।

এই বাঁধ থেকে ভাগিরথী-হুগলী নদী পর্যন্ত ফিডার খালটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৪০ কিলোমিটার। এই অপরিনামদর্শী প্রকল্প বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বিহার রাজ্যে ব্যাপক পরিবেশ বিপর্যয় ডেকে আনে।

শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এতে বাংলাদেশকে কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ পরিবহন, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসানের সম্মুখীন হতে হয়। প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশের প্রায় ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়; যদি পরোক্ষ হিসাব করা হয়, তাহলে ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি হবে। প্রফেসর এম, আই চৌধুরী এবং সৈয়দ সফিউল্লাহ জাতিসংঘ পরিবেশ অধিদপ্তর ও হামবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌথ উদ্যোগে অনুষ্ঠিত ‘গ্লোবাল কার্বন প্রবাহ’ গবেষণা প্রকল্পে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে আসে । ৮ বছরের সমীক্ষার ফলাফল সংক্ষেপে নিম্নরূপ :

১. পদ্মা নদী দিয়ে পলি প্রবাহ প্রায় ২০ শতাংশ কমে গেছে (১৯৬০ সালের তুলনায়)।

২. কার্বন প্রবাহ কমেছে ৩০ শতাংশ।

৩. পলি প্রবাহ কমে যাওয়ার কারণে জমির উর্বরা শক্তি কমে যাচ্ছে।

৪. মিনারেল এবং নিউট্রিয়েন্ট কমে যাওয়ার ফলে নদী ও জলাভূমিতে ফাইটোপ্লাকটন উৎপাদন কমেছে ৩০ শতাংশ। ফাইটোপ্লাকটন হচ্ছে খাদ্য চক্রের প্রথম ধাপ। এ থেকে ক্রমান্বয়ে মাছ ও অন্য জলজ জীবের উৎপাদন ঘটে। পদ্মা-ব্রক্ষপুত্রের মিলনস্থল আরিচাঘাটে সমীক্ষা থেকে যে ফিশ ক্যালেন্ডার তৈরি করা হয়েছে তাতে দেখা যায় ৩৫ বছর আগের তুলনায় বর্তমান মৎস্য উৎপাদন মাত্র ২৫ শতাংশ। ইলিশ মাছ এখানে পাওয়া যায় না বললেই চলে। ইলিশ মাছ স্যাড গোত্রীয় মাছ। ০-৪২০ বিষ্ণুরেখার যেখানে সমুদ্র সংলগ্ন নদী রয়েছে সেখানেই এই মাছ পাওয়া যায়। বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে এই মাছ নোনা পানি থেকে মিঠা পানিতে আসে ডিম পাড়ার জন্য। উজানে এদের আগমন বাঁধ কিম্বা ঐ ধরনের বাধার পরিপ্রেক্ষিতে এরা অত্যন্ত সংবেদনশলীল। ফারাক্কার আগে এক সময় রাজশাহী পদ্মা অবধি ইলিশ মাছ পাওয়া যেত। এখন আরিচাতেই এ মাছ পাওয়া যায় না। ফারাক্কা বিদ্যমান থাকলে আশঙ্কা করা হয় পদ্মা এবং তার কমান্ড অঞ্চলে ইলিশ মাছ আদৌ পাওয়া যাবে না।

৫. জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দুধারি তলোয়ারের মতো কাজ করছে। একদিকে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূল অঞ্চল তলিয়ে যাওয়া আর তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বাংলাদেশের সমতল ভূমির ক্রমান্বয়ে দেবে যাওয়া। যাকে বলা হয় সাবসিডেন্স। এর হার বছরে ৫ মি.মি.। নদীর প্লাবনের কারণে সঞ্চিত পলি সাবসিডেনসের নেতিবাচক প্রভাবকে এতকাল পুষিয়ে নিয়ে আসছিল। ফারাক্কার কারণে এমনটি আর হতে পারছে না ।

৬. টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর টোশিও ইসুজুকা ও আমাদের যৌথ গবেষণায় স্ট্রনসিয়াম আইসোটপ সমীক্ষার মাধ্যমে দেখা গেছে যে পুরো বঙ্গোপসাগর জুড়ে সময় অনুচক্রে তীব্র ফাইটোপ্লাকটন বিকাশ ঘটে। আর এর অনুঘটক হচ্ছে নদী বাহিত নিউট্রিয়েন্ট বা পুষ্টি উপাদান ও মিনারেল। ফারাক্কা বাঁধের কারণে প্রক্রিয়াটি বিঘ্নিত হচ্ছে। ফলে সমগ্র বঙ্গোপসাগর জুড়ে মৎস্য উৎপাদন আশঙ্কাজনকভাবে কমে যেতে পারে। বঙ্গোপসাগরের মাছের উপর ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠিও নির্ভরশীল।একই সঙ্গে কার্বন প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে গ্রীন হাউস প্রতিক্রিয়ার উপশম কম হবে

৭. প্রফেসর কেট ক্র্যান্ক (কানাডা) এর সঙ্গে যৌথ গবেষণায় দেখা যায় যে ফারাক্কার কারণে নদী বাহিত পলির গ্রেইন সাইজ স্পেকট্রাল প্যার্টান অর্থাৎ পলি কণার আকারের তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটছে। এই পরিবর্তন বাংলাদেশের মাটির ভৌত কাঠামোর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

ফারাক্কার প্রভাবে বাংলাদেশ অংশের পদ্মা পরিণত হয়েছে একখণ্ড মরুভূমিতে। পদ্মার পানি প্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অববাহিকায় বিশেষ করে রাজশাহী, চাপাইনবাবগঞ্জ ভূগর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ৮-১০ ফুট জায়গা বিশেষে ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। পানির অভাবে মাটির আদ্রতা শুষ্ক মওসুমে ৩৫% কমে গেছে। পানি প্রবাহের এমন করুণ অবস্থা থেকে সৃষ্ট হয় মরুকরণ প্রক্রিয়া। নদীর পানি থেকে জলীয় বাষ্প সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের বায়ুর আদ্রতা সৃষ্টিতে নিয়ামক ভূমিকা পালন করে। খরার সময় পদ্মা নিজেই যখন বিশুষ্ক মরুভূমিতে পরিণত হয় সে তখন স্থলভূমির বায়ুতে আদ্রতার যোগান কিভাবে দিবে। আদ্রতার অভাবে দিনের নিম্নতম এবং উচ্চতম তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পায়। ৬০ দশকে এই তারতম্য যেখানে ৫-৮ সে. ছিল এখন সেটা বৃদ্ধি পেয়ে ৮-১২ সে. এ দাঁড়িয়েছে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মরুকরণ প্রক্রিয়ার ব্যাহিক রূপ এই অঞ্চলের জনগণ ইতিমধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন।

ফারাক্কা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গঙ্গা নদীর (পদ্মা) প্রবাহে চরম বিপর্যয় ঘটে। প্রবাহ কমে যাওয়ায় নদীর নাব্যতা কমে যায়। বাঁধের ফলে প্রায় একশ কিলোমিটার নদীপথ নাব্যতা হারিয়েছে। সেই সঙ্গে ৪৯টি শাখানদীর অস্তিত্ব সম্পূর্ণ বিলীন হয়েছে। ফলে প্রায় বাংলাদেশর বর্তমানে প্রায়ই বড় বন্যা সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

ফারাক্কা ব্যারেজ চালুর গত চার দশকে গঙ্গা অববাহিকায় ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। গঙ্গার উজানে বিহার, উত্তর প্রদেশ এবং ভাটিতে সুন্দরবন পর্যন্ত পরিবেশ বিপর্যয়ের চিত্র আজ স্পষ্ট। গঙ্গার উজানে বিপুল পরিমাণ পলি জমে প্রতিবছর বন্যা দেখা দিচ্ছে ভারতের বিহারসহ উত্তর প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায়। অন্যদিকে গ্রীষ্ম মৌসুমে পানি আটকে রাখার ফলে নদীর ভাটি অঞ্চলের মানুষ। ফারাক্কা বাঁধের ফলে প্রতি বছর কেবল বিহারেই ২০ লাখ মানুষ হুমকির মুখে পড়ছে।

বাংলাদেশে আসা গঙ্গাবাহিত পলির পরিমাণ ২ বিলিয়ন টন থেকে ১ বিলিয়ন টনে নেমে এসেছে। এর ফলে মেঘনা মোহনায় অবস্থিত উপকূলীয় চরাঞ্চলের গঠন প্রক্রিয়া ব্যহত হচ্ছে। এই ধারা চলমান থাকলে বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে ভূমি গঠন এবং ভূমি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া বিপর্যস্ত হয়ে যাবে।

এই বাঁধের কারণে এক সময়ের প্রমত্ত পদ্মার এখন মুমূর্ষু অবস্থা। এ অঞ্চলের সবুজ-শ্যামল বাংলা হয়তো অচিরেই মরুভূমিতে পরিণত হবে। শুষ্ক মৌসুমে গঙ্গার পানি অপসারণের ফলে বাংলাদেশের কৃষি, মৎস্য, বনজ, শিল্প, নৌ-পরিবহন,, পানি সরবরাহ ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপক লোকসান হচ্ছে। আর্থিক মূল্যে প্রতি বছর বাংলাদেশের প্রত্যক্ষভাবে প্রায় ৩শ কোটি মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়। পদ্মার পানিপ্রবাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়ায় বাংলাদেশের উত্তর অববাহিকায় রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকার ভূ-গর্ভস্থ পানির প্রথম স্তর ৮ থেকে ১০ ফুটের জায়গায় ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। মৌসুমি বৃষ্টিও এই স্তরের পানির অভাব পূরণ করতে পারছে না!

শুষ্ক মৌসুমে পানির অভাবে মাটির আর্দ্রতা কমে গেছে ৩৫ শতাংশ। আর্দ্রতার অভাবে দিনের নিম্নতম ও উচ্চতম তাপমাত্রার তারতম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বাংলাদেশের গড়াই নদী এখন এই মরুকরণ প্রক্রিয়ায় প্রায় বিলুপ্ত।

মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় কৃষিক্ষেত্রে এর ভয়াবহ প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পানির স্তর অনেক নেমে যাওয়ার দক্ষিণ অঞ্চলের জি-কে সেচ প্রকল্প মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। মাটির আর্দ্রতা, লবণাক্ততা, মিঠা পানির অপ্রাপ্যতা কৃষির মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।

বাঁধের ফলে খুলনা অঞ্চলের মাটির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা খুলনার রুপসা নদীর পানিতে ৫৬৩.৭৫ মিলিগ্রাম/লিটার ক্লোরাইড আয়নের উপস্থিতি পেয়েছেন। তাছাড়া, মিঠা পানির সরবরাহ কমে যাওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে লবণ, ভূ-অভ্যন্তরস্থ পানিতে প্রবেশ করছে।

মাটির আর্দ্রতা হ্রাস, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, মিঠা পানির অপ্রাপ্যতার জন্য মৎস্য সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। গঙ্গার অনিয়ন্ত্রিত পানি প্রবাহের কারণে এ এলাকার প্রায় দুই শতাধিক মাছের প্রজাতি ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি হুমকির সম্মুখীন। মাছের সরবরাহ তমে যাওয়ার ফলে কয়েক হাজার জেলে বেকার হয়ে পড়েছে। শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশের ৩২০ কিলোমিটারের বেশি নৌ পথ নৌ চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।

সম্প্রতি ভারতেও ফারাক্কার বিরুদ্ধে জনমত জোরালো হচ্ছে। কারণ, ফারাক্কা এখন সুবিধার চেয়ে অসুবিধাই বেশি ঘটাচ্ছে। যে কলকাতা বন্দর টিকিয়ে রাখতে এই বাঁধ দেওয়া হয়েছিল, বাঁধ নির্মাণের ৪৮ বছর পরেও  কলকাতা বন্দরকে বাঁচানো যায়নি। এমনকি কলকাতা বন্দরকে সচল রাখতে বর্তমানে যে পরিমাণ ড্রেজিং করতে হয়-ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের আগেও এতটা ড্রেজিং দরকার হতো না। বাঁধ নির্মাণের আগে স্থানীয় অধিবাসীদের বলা হয়েছিল, ফারাক্কা চালু হলে আর বন্যা হবে না। কিন্তু অতীতের তুলনায় ভয়াবহ বন্যা দেখা গিয়েছে শুধু বাঁধের কারণে।

শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, পার্শ্ববর্তী বিহারও ফারাক্কা বাঁধের কারণে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। সেখানে চলমান বন্যায় ১০ লাখের বেশি মানুষ ও ২ লাখ মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিহার রাজ্য সরকারের দাবি, ফারাক্কা বাঁধের কারণেই এই ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং প্রায় প্রতিবছরই রাজ্য বন্যা ও নদীভাঙনের শিকার হচ্ছে। বছর বছর বন্যার ক্ষয়ক্ষতি থামাতে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নিতীশ কুমার ফারাক্কা ব্যারেজ ভেঙে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু বিশেষজ্ঞ এবং উন্নয়নকর্মীরা বলছেন বাঁধটি ভেঙে না ফেলে এর সড়ক ও রেল যোগাযোগ ঠিক রেখে বাঁধের গেইটগুলো অপসারণ করে ফেললেই হয়।

নদীতে এ ধরনের বাঁধের ফলে যদি লাভের চেয়ে লোকসান বেশি হয় সেক্ষেত্রে তা তুলে ফেলার একাধিক নজির ইউরো-আমেরিকায় রয়েছে। তাই বাংলাদেশ-ভারত উভয় দেশের জন্য অভিশাপস্বরূপ এই ফারাক্কা বাঁধ অবিলম্বে বন্ধ করে দেওয়াই হবে উভয় দেশের জন্য মঙ্গলজনক।