সরকার পতনের দিন গত ৫ অগাস্ট যাত্রাবাড়ী থানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। হত্যা করে দুই তরুণকে সেই থানার ভেতরই ফেলে রাখা হয় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক:  পুড়ে ধ্বংসস্তূপ হয়ে যাওয়া যাত্রাবাড়ী থানা থেকে কালি-ঝুলি মাখা অবস্থায় দুই তরুণকে উদ্ধার করে বুধবার ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলেন কয়েকজন। তাদের একজনকে চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন, আরেকজন ১১টার দিকে মারা যান। তাদের গায়ে অনেকগুলো ‘ছিলা-কাটা’ ও ‘নীলা-ফুলা’ জখম পাওয়ার কথা উল্লেখ করে পুলিশের করা সুরতহাল প্রতিবেদনে তাদের ‘মারপিট’ করার কথা বলা হয়েছে।

নিহত তরুণরা হচ্ছেন ১৯ বছর বয়সী সাইদুল ইসলাম ইয়াসিন ও ২০ বছর বয়সী সাইদ আরাফাত শরিফ। পুলিশ বলছে, তাদেরকে নিয়ে আসা ব্যাক্তিরা ‘গণপিটুনি’তে মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে।

দুই তরুণই শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ ও থানা পাহারা দেওয়ার কাজ করছিলেন বলে স্বজনেরা জানাচ্ছেন। তাদের অভিযোগ, স্বেচ্ছাসেবকদের নেতৃত্ব নিয়ে দ্বন্দ্বে তাদের পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

সেখানকার স্বেচ্ছাসেবকদের একজন আবার দাবি করেছেন, ভোররাতের দিকে একটি হোটেলের ঢুকে ধর্ষণ চেষ্টার সময় হাতেনাতে ধরে ফেলে তাদের মারধর করে স্থানীয়রা।

একই এলাকায় দুপুরের পর আরও একটি মরদেহ পাওয়া যায়, তার গায়েও ছিল মারপিটের চিহ্ন।

ঢাকা মেডিকেল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, ইয়াসিন ও শরীফকে সকালে সায়েদাবাদ এলাকায় পিটিয়ে ফেলে রাখা হয়। সেখান থেকে কে বা কারা তাদের যাত্রাবাড়ীতে রেখে যায়। পরে কয়েকজন ছাত্র তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসে। সকাল সোয়া ১০টার দিকে দুই তরুণকে হাসপাতালে আনার পর শরীফকে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। আর ১১টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইয়াসিন মারা যান বলে বাচ্চু মিয়া জানান।

দুজনেরই সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করেছেন শাহবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) শাহাদাৎ আলী। এতে বলা হয়েছে, সাইদ আরাফাতের ডান হাতে থেঁতলানো জখম, পিঠের ডানপাশে, নিতম্বে ছিলা, জখম রয়েছে। আর ইয়াছিনের বাম চোখের ওপরে কাটা জখম, বুকে ও পেটে নীলা-ফুলা জখম রয়েছে।

ইয়াসিনের সুরতহালে  শাহাদাৎ আলী লিখেছেন, সাক্ষী এবং মৃত্যুর প্রমাণপত্র পর্যালোচনায় জানা যায়, বুধবার ভোর ৫টা থেকে ৬টার মধ্যে যাত্রাবাড়ী থানার ভেতরে তাকে গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া যায়। এই ভিকটিম যাত্রাবাড়ী থানার পাশে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করত।

সাইদ আরাফাতের সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ লিখেছে, সকাল সাড়ে ৭টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার ভেতর থেকে গুরুতর আহতাবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে এলে চিকিৎসকেরা পরীক্ষার পর তাকে মৃত ঘোষণা করেন। তিনি যাত্রাবাড়ী এলাকায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছিলেন।

নিহত সাইদ আরাফাতের চাচাত ভাই সোহাগ মিয়া বলেন, আমরা জানি না কারা তাকে মারল। 

চলতি বছর যাত্রাবাড়ী আইডিয়াল স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছিল আরাফাত। তিনি অনলাইনে পোশাকের ব্যবসা করত। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে সবার বড়। তার বাবা কবীর হোসেন ব্যবসা করেন।

সোহাগ মিয়া বলছেন, আরাফাত গত কয়েকদিন আন্দোলনে যুক্ত ছিল। সরকার পতনের পর থেকে থানা পাহারা, ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ এসব কাজ করছিল। রাতে বাড়ির বাইরে ছিল। সকালে ঢাকা মেডিকেল থেকে কেউ একজন আরাফাতের মাকে ফোন করে হাসপাতালে যেতে বলে। তিনি হাসপাতালে গিয়ে লাশ পান।

জানতে চাইলে ইয়াসিনের মা শিল্পী আক্তার ঢাকা মেডিকেলে সাংবাদিকদের বলেন, লিডার নিয়া ঝামেলায় আমার পোলারে পিডায়া মারছে।

মঙ্গলবার রাতে পুড়ে যাওয়া যাত্রাবাড়ী থানা পাহারা দিতে হবে বলে মাকে জানিয়েছিলেন ইয়াসিন। বৃহস্পতিবার ভোরে পোড়া থানার ভেতরেই তাকে কালি-ঝুলি মাখা, গুরুতর আহত অবস্থায় পাওয়া যায়।

শিল্পী আক্তার বলেন, রাত দেড়টায় পোলার সাথে কথা হইছে। আবার ৪টার সময় কথা হইছে। আমি জিগাইছি, ‘আব্বু তুমি কিছু খাইছ?’ আমারে কইছে বিরানি খাইছে। এরপর ভোর ৪টায় কথা হইছে। আমারে বলছে, ‘মা চিন্তা কইর না, সকালে আসব’। সকালে আগের বাসাওয়ালা ফোন দিয়ে বলে, ‘আপনার ছেলে হাসপাতালে, সেখানে যান।

ইয়াছিনের মা বলছেন, তিনি হাসপাতালে এসে শুনেছেন ধর্ষণের অভিযোগে তার ছেলেকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে। সেই অভিযোগকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করে শিল্পী বলেন, “আমি যখন তাদের জিজ্ঞেস করলাম কী করছে আমার পোলা, তারা বলল ‘ও ধর্ষণ করছে’। আমি জানতে চাইছি কী প্রমাণ আছে, তারা বলছে, ‘ভিডিও আছে’। কিন্তু তারা ভিডিও দেয়নি নিজেদের ফোন নম্বর এবং পরিচয়ও জানায়নি।

যাত্রাবাড়ীর একজন স্বেচ্ছাসেবক ও মাদ্রাসা শিক্ষার্থী জানান, ওই দুজনসহ সম্ভবত আরও একজন ভোরবেলা ওই এলাকার একটি হোটেলে গিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা চালায়। তখন সেখানে থাকা লোকজন তাদের ধরে থানার ভেতর এনে মারপিট করে।

এই অভিযোগকে মিথ্যা বলছেন ইয়াছিনের মা, পাশাপাশি তিনি নেতৃত্বের দ্বন্দ্বের কথা বলছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই মাদ্রাসা শিক্ষার্থী বলেন, “আমাদের এখানে তো কেউ নেতা না। তাইলে দ্বন্দ্ব হইব কেন? আমরা সবাই এখন আছি, পুলিশ আসলে চইলা যাব।”

আরেকটি লাশ
বুধবার দুপুরে যাত্রাবাড়ী মাছের আড়তের কাছ থেকে আরও এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসেন কয়েকজন। তার শরীরেও মারধরের চিহ্ন রয়েছে। তার বয়স হতে পারে ২৫ থেকে ৩০ এর মধ্যে। পরনে ছিল গেঞ্জি ও হাফ প্যান্ট।

কী করে তার মৃত্যু হল সে বিষয়ে সন্ধ্যা কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।