সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার এম মনসুর আলী জাতীয় উচ্চবিদ্যালয় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন  

প্রতিনিধি রাজশাহী: এইচএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রটি সিরাজগঞ্জে; রাজশাহীর বোর্ডের অধীন। তদন্তে ধরা পড়েছে, এই কেন্দ্রে ‘মিশন এ প্লাস হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের’ মাধ্যমে পরীক্ষার হলে মুঠোফোনের মাধ্যমে উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয়। পরীক্ষার্থীরা প্রকাশ্যে স্মার্টফোনে আসা উত্তরপত্র দেখে দেখে লেখেন।

কেন্দ্রটির নাম ‘এম মনসুর আলী জাতীয় উচ্চবিদ্যালয়’। এটি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর উপজেলার মনসুর নগর ইউনিয়নে অবস্থিত। চলতি বছর এই কেন্দ্রে উত্তরপত্র সরবরাহের কাজে নিয়োজিত ও পরীক্ষার হলে ব্যবহৃত ৮৯টি মুঠোফোন জব্দ করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কেন্দ্র সচিবকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। নকলে সহায়তা করার কারণে চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। নকল করার সুবিধা পাওয়ায় ঢাকা ও ময়মনসিংহ বোর্ড থেকে এসএসসি পাস করা অনেকে শিক্ষার্থী ওই কেন্দ্র থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেয়।

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এম মনসুর আলী জাতীয় উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে এবার এইচএসসি পরীক্ষার্থী ছিলেন ৬৮২ জন। এর মধ্যে ময়মনসিংহ বোর্ড থেকে এসএসসি পাস ২৩৭ জন, ঢাকা বোর্ড থেকে ৫৬ জন, মাদ্রাসা বোর্ড থেকে ২৩ জন, কারিগরি বোর্ড থেকে ৩৫ জন এবং রাজশাহী বোর্ডের ৩৩১ জন।

চর এলাকা মনসুর নগর ইউনিয়ন যমুনা নদীর কারণে উপজেলা সদর কাজীপুর থেকে বিচ্ছিন্ন। এখানে উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পড়াশোনার জন্য একমাত্র শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ। এই কলেজের শিক্ষার্থীদের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কেন্দ্র করা হয় পাশের মনুসর আলী জাতীয় উচ্চবিদ্যালয়ে। মনসুর নগর ইউনিয়নের স্থলভাগ জামালপুরের সরিষাবাড়ী উপজেলার সঙ্গে যুক্ত।

অভিযোগ রয়েছে, অন্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা মূলত নকলের এই বিশেষ সুবিধার জন্য আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজ ভর্তি হয়। এখানে ভর্তি হলে মনুসর আলী জাতীয় উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাওয়া। কলেজ কর্তৃপক্ষ মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করে থাকে। আর পরীক্ষার সময় দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ‘মিশন এ প্লাস হোয়াটস অ্যাপ গ্রুপের’ সদস্য হওয়া যায়। এই গ্রুপ ছাড়াও ‘রাসেলস ভাইপার’ নামের আরেকটি গ্রুপ থেকে উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয় বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। তবে এই গ্রুপ থেকে শুধু মানবিক বিভাগে পরীক্ষার্থীদের উত্তরপত্র সরবরাহ করা হয়। চার–পাঁচ বছর ধরে এভাবেই চলছে।

এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় মনুসর আলী জাতীয় উচ্চবিদ্যালয় কেন্দ্রে ব্যাপক অনিয়ম–দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এ ঘটনা তদন্তের জন্য কাজীপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শরিফুল ইসলামকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা ৭–৯ জুলাই সরেজমিন পরিদর্শন করেন এবং ৯ জুলাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এর ভিত্তিতে কাজীপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সোহরাব হোসেন ১৫ জুলাই সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কাছে প্রতিবেদন দাখিল করেন। এর অনুলিপি রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাছেও দেওয়া হয়। বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরিফুল ইসলাম এই প্রতিবেদন পাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন।

প্রতিবেদন সূত্রে জানা গেছে, দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্র সচিব সরিষাবাড়ীর দৌলতপুর ফাজিল মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আবদুল খালেক অননুমোদিতভাবে আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদকে কেন্দ্রের ভেতরে অবস্থান করার সুযোগ করে দিয়েছেন। এ বিষয়ে তিনি তদন্ত কমিটির কাছে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। এ ছাড়া কেন্দ্রে নিযুক্ত মোট সাতজন এমএলএসএসের মধ্যে ছয়জনই আলহাজ ফরহাদ আলী মেমোরিয়াল ডিগ্রি কলেজের। তাঁরা অন্যান্য কাজের পাশাপাশি প্রশ্ন ও উত্তরপত্র কক্ষে নিয়ে যান। সার্বিক পর্যালোচনায় তদন্ত কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, অধ্যক্ষ আবুল কালাম আজাদ বিধিবহির্ভূতভাবে পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট সব কাজ পরিচালনা করে আসছেন এবং এর ফলে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে এই অনৈতিক পন্থা গ্রহণের প্রবণতা তৈরি হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বিগত কয়েক বছর ধরেই তিনি (আবুল কালাম আজাদ) পরীক্ষাসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিয়ন্ত্রণ করেন। কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে শিক্ষার্থীদের এ ধরনের অনৈতিক কাজের সহযোগিতার কারণে শিক্ষা বোর্ড পরিবর্তন করেও সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তির নজির রয়েছে। অধ্যক্ষের এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠনপূর্বক প্রয়োজনীয় তদন্তের সুপারিশ করা হয়েছে।
আর ‘মিশন এ প্লাস হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে’র মাধ্যমে প্রশ্নোত্তর আদান–প্রদানের বিষয়টি অধিকতর যাচাই–বাছাইয়ের জন্য তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন বলে প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে গ্রুপের অ্যাডমিন শাকিল, শাওন ও সুমন নামের তিনজনের ফোন নম্বরও উল্লেখ করা হয়েছে।

ওই তিনজনের মুঠোফোন নম্বরে গত কয়েক দিন একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও বন্ধ পাওয়া গেছে।

এদিকে বিধিবহির্ভূতভাবে পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বনে শিক্ষার্থীদের সহায়তার সময় হাতেনাতে ধরা পড়ায় প্রতিষ্ঠানের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী শেফালী বেগমকে সাত দিনের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। পরীক্ষার কেন্দ্রসংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে আরও তল্লাশি চালিয়ে ৭৮টি মুঠোফোন সেটসহ মোট ৮৯টি মুঠোফোন সেট কেন্দ্র সচিবের হেফাজতে দেওয়া হয়েছে।

৮ জুলাই থেকে কেন্দ্র সচিব পরিবর্তন করে কাজীপুর সরকারি মনসুর আলী কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলমকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এরপর অননুমোদিতভাবে মুঠোফোন কাছে রাখার জন্য ৯ জুলাই পাঁচজন ও ১১ জুলাই তিন পরীক্ষার্থীকে বহিষ্কার করা হয়।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান কেন্দ্র সচিব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম দায়িত্ব নেওয়ার পরদিন ৯ জুলাই পরীক্ষার পরে কিছু শিক্ষার্থী লাঠিসোঁটা নিয়ে কেন্দ্র সচিবকে ঘেরাও করেন। পরে তিনি স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও তাঁর ছাত্রদের ফোন করে নিয়ে এসে কেন্দ্র থেকে বের হন।

এ ব্যাপারে সোমবার কেন্দ্র সচিব মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, পরীক্ষা শেষে কর্তৃপক্ষের কাছে এ বিষয়ে তিনি একটি প্রতিবেদন দেবেন।

রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক আরিফুল ইসলাম  বলেন, ওই ঘটনার বিষয়ে তাঁরাও একটি তদন্ত করছেন। প্রতিবেদন হাতে পেলে বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে আলাপ করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।