মংডুতে সংঘাতের তীব্রতা বাড়ছে, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের আশঙ্কা

অনুপ্রবেশ ঠেকাতে কক্সবাজারের টেকনাফ সীমান্তে টহল ও নজরদারি বাড়িয়েছে বিজিবি | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি টেকনাফ: টানা তিন দিন বন্ধ থাকার পর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে সশস্ত্র গোষ্ঠী আরাকান আর্মির (এএ) সংঘাত-লড়াই আবার শুরু হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে আবার উভয় পক্ষের সংঘাত শুরু হয়। আজ শনিবার দুপুর ১২টা পর্যন্ত রাখাইনে গোলাগুলির পাশাপাশি মর্টার শেল, গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেয়েছেন বাংলাদেশের টেকনাফের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা।

সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, রাখাইন রাজ্যের মংডু টাউনশিপের অভ্যন্তরে আজ শনিবার সকালেও আগুনের কুণ্ডলী ও ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। দেখা গেছে যুদ্ধবিমানের চক্কর।

পাঁচ কিলোমিটার প্রস্থের নাফ নদীর এক পাশে মিয়ানমার, অন্যদিকে বাংলাদেশ। সকাল ১০টায় সরেজমিনে টেকনাফের নেটং পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ওপারের মংডু টাউনশিপে মুহুর্মুহু বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। এতে এপারে তীব্র ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে। নাফ নদীতে টহল দিতে দেখা গেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ডের সদস্যদের। এ ছাড়া সীমান্তের বিভিন্ন স্থানে দাঁড়িয়ে বিজিবি সদস্যরা ওপারের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।

সীমান্তে নিয়োজিত একজন বিজিবি সদস্য জানান, আগের তুলনায় মংডুতে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েছে। নাফ নদী পেরিয়ে ওপারের লোকজন টেকনাফ অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছেন। কিন্তু সে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। অনুপ্রবেশের সময় অনেককে আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

সীমান্তের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, টানা ছয় মাসের বেশি সময় ধরে রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির লড়াই চলছে। ইতিমধ্যে আরাকান আর্মি মংডু টাউনশিপের আশপাশে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) ২৫টি সীমান্তচৌকি, রাচিডং-বুচিডং টাউনশিপের বেশ কয়েকটি থানা ও পুলিশ ফাঁড়ি দখলে নিয়েছে। বর্তমানে মংডু টাউন এবং পাশের পাঁচটি গ্রাম সুধাপাড়া, মংনিপাড়া, সিকদারপাড়া, উকিলপাড়া, নুরুল্লাপাড়া দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে আরাকান আর্মি। এসব গ্রাম রোহিঙ্গা মুসলিম অধ্যুষিত।

গ্রামগুলোর বিপরীতে (পশ্চিমে) নাফ নদীর এপারে টেকনাফের সাবরাং ইউনিয়ন। নাফ নদী পাড়ি দিয়ে ওপারের লোকজনের সাবরাং এলাকায় অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছেন বেশি। সাবরাং ইউনিয়নের আছারবনিয়া গ্রামের লবণচাষি জাহেদ উল্লাহ (৪৫) বলেন, গতকাল শুক্রবার বিকেল পাঁচটার দিকে মংডু টাউনশিপ ও পাশের সুধাপাড়া থেকে মর্টার শেলের বিকট শব্দ শোনা গেছে। তখন সুধাপাড়ায় ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে। আকাশে ছিল যুদ্ধবিমান। সকাল ৯টার দিকেও কয়েকটি স্থানে আগুনের কুণ্ডলী দেখা যায়।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডুর আকাশে আগুনের ধোঁয়ার কুন্ডলী। গতকাল বিকালে। টেকনাফের সাবরাং সীমান্ত | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে মংডুতে বিকট শব্দের বিস্ফোরণ শোনা যাচ্ছে। আজ শনিবার দুপুর পর্যন্ত থেমে থেমে বিস্ফোরণ ঘটছে। শক্তিশালী বিস্ফোরণে টেকনাফের সাবরাং, টেকনাফ সদর ও হ্নীলা ইউনিয়নের অন্তত ২৩টি গ্রামে ভূকম্পন অনুভূত হয়েছে।

সীমান্তের একাধিক সূত্র জানায়, মংডু টাউনসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের রোহিঙ্গারা শুরু থেকে সরকারি বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আরাকান আর্মির রোষানলে পড়েন। লাখো রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে গৃহহীন হয়েছেন। হাটবাজার-দোকানপাট বন্ধ এবং ঘরবাড়ি থেকে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গাদের খাবার ও পানীয় জলের তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। সীমান্তে জড়ো হয়ে ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি নাফ নদীতে কয়েক দফায় নৌকাডুবির ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি নাফ নদী ও সাগর উপকূল থেকে কয়েক দফায় ৫৪ জন রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ২৩ জন নারী ও শিশু।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক টেকনাফের আশ্রয়শিবিরের একজন রোহিঙ্গা নেতা বলেন, মংডুর চলমান যুদ্ধে অনেক রোহিঙ্গা প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাণ বাঁচাতে অনেক রোহিঙ্গা নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন। কিছু রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে আত্মীয়স্বজনের বাসাবাড়িতে আশ্রয় নিচ্ছেন। তাঁদের কয়েকজনকে আটক করে পুনরায় মংডুতে ফেরত পাঠানোর ঘটনাও ঘটছে।

উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির দেওয়া তথ্যমতে, সর্বশেষ ১৪ আগস্ট নাফ নদী অতিক্রম করে টেকনাফে পালিয়ে আশ্রয় নেন মিয়ানমার বিজিপির ১৩ জন সদস্য। তাঁরা একটি নৌকায় করে টেকনাফ পালিয়ে আসেন। গত জুলাই মাসে কয়েক দফায় পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন ১২৩ জন বিজিপি সদস্য।

টেকনাফের দমদমিয়া বিজিবি ক্যাম্পের পাশের একটি বহুতল ভবনে বিজিপি সদস্যদের রাখা হয়েছে।

পুলিশ ও বিজিবি সূত্রে জানা যায়, গত ফেব্রুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত সময়েও কয়েক দফায় দেশটির ৭৫২ জন বিজিপি ও সেনাসদস্য পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিন দফায় কক্সবাজার থেকে সমুদ্রপথে তাঁদের মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়।

টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. আদনান চৌধুরী বলেন, সীমান্ত দিয়ে কাউকে অনুপ্রবেশের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে না। সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে অনুপ্রবেশ করা কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গাকে পুনরায় ফেরত পাঠানো হয়েছে।