ক্ষুদ্রঋণের সেবা মাশুল ২৪% কি বেশি না কম

ফখরুল ইসলাম: সুদের হার বা সার্ভিস চার্জ (সেবা মাশুল) ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো আগে যে যার মতো নিত। উচ্চ হার নিয়ে সমালোচনা ছিল অনেক। সরকার ২০১০ সালে প্রথমবারের ক্ষুদ্রঋণের সেবা মাশুল ২৭ শতাংশ বেঁধে দেয়। ২০১৯ সালের মাঝামাঝি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথোরিটি (এমআরএ) তা ৩ শতাংশ কমিয়ে নিয়ে আসে ২৪ শতাংশে। এ হারই বহাল আছে এখনো।

বিদ্যমান সুদের হার বা সেবা মাশুলের হার বেশি না কম, তা নিয়ে বিতর্ক শেষ হয়নি এখন। আবার ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো একে সুদের হারও বলে না, বলে সেবা মাশুল। এমআরএ সম্প্রতি এ সেবা মাশুলের হারকে আরও যৌক্তিকীকরণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে কাজ করছে একটি কারিগরি কমিটি। কমিটি এ বিষয়ে তাদের প্রতিবেদন তৈরির পর তা সুপারিশসহ অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কাছে পাঠাবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ওখান থেকেই আসবে।

এ বছরের জুন পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী এমআরএ থেকে সনদ নেওয়া প্রতিষ্ঠান এখন ৭২৪ টি। ব্র্যাক, আশা, বুরো বাংলাদেশ, টিএমএসএস, এসএসএস, সাজেদা ফাউন্ডেশন, উদ্দীপন, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন, শক্তি ফাউন্ডেশন-এ ১০টি দেশের শীর্ষ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান। ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকদের ৯০ দশমিক ৫৪ শতাংশই নারী।

এমআরএর এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ বলেন, ‘ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা মাশুলের হার নিয়ে কমিটি কাজ করছে। এরই মধ্যে বন্যা শুরু হয়ে গেল। দেখা যাক, কমিটির সুপারিশ কী আসে। যে সুপারিশই আসে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে সরকার।’

ক্ষুদ্রঋণ বাংলাদেশের আর্থসামাজিক ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে, যা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। যেসব দরিদ্র নারী ঘরের চার দেয়ালে বন্দী ছিলেন, তাঁরাও ক্ষুদ্রঋণের সুবাদে এখন অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নিজেদের সম্পৃক্ত করেছেন।

একসময় ক্ষুদ্রঋণদানকারী সংস্থাগুলো ঋণগ্রহীতাদের কাছ থেকে ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্তও সুদ নিত। সুদের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো নিয়মনীতি ছিল না। অতীতে ক্ষুদ্রঋণের উচ্চ সুদের হার নিয়ে দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে।

ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিলের একটা উল্লেখযোগ্য অংশের জোগানদার পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)। এই সংস্থা থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো মাত্র ৪-৬ শতাংশ হারে ঋণ পেয়ে থাকে। তাই ক্ষুদ্রঋণের সেবা মাশুল বা সুদের হার কোনোভাবেই ২০ শতাংশের বেশি হওয়া বাঞ্ছনীয় নয় বলে মনে করেন অনেকে।

কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আবার ব্যাংক থেকেও ঋণ নেয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংকের নেওয়া পদক্ষেপের ফলে ব্যাংক খাতে ঋণের সুদের হার এখন ১০ থেকে ১৫ শতাংশের ঘরে। তাই যেসব ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে উচ্চ সুদের কারণে তাদের এখন কার্যক্রম চালাতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। ছোট কয়েকটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এমন আভাস পাওয়া গেছে।

দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান আশা। আশা ইন্টারন্যাশনালের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি বিশ্বের অন্য দেশগুলোতেও কাজ করে। আশা ইন্টারন্যাশনালের সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. এনামুল হক বলেন, ব্যাংক খাতে সুদের হার বেড়ে যাওয়ায় এ পর্যায়ে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সেবা মাশুল কমানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হবে না। তেমন সিদ্ধান্ত নিলে অনেক প্রতিষ্ঠান টিকতে পারবে না। ভারতে সেবা মাশুল এখনো ২৬ থেকে ২৭ শতাংশ। শ্রীলঙ্কায় কমানো হয়েছিল। ফলে দেশটির অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

এক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের দেনা পরিশোধ করার এক ধরনের অসুস্থ চর্চা রয়েছে জানিয়ে এনামুল হক বলেন, গ্রাহকদের ঋণের তথ্য না থাকায় প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় অন্ধকারে ঋণ দিচ্ছে। এটি নিয়েও নতুন করে ভাবার আছে।

ক্ষুদ্রঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর দিক থেকে ক্ষুদ্রঋণের বর্ধিত সুদহারের পক্ষে যুক্তি হচ্ছে, ব্যাংক ব্যবস্থায় গ্রাহক ব্যাংকের কাছে যান আর ক্ষুদ্রঋণদাতারা দুয়ারে দুয়ারে যান গ্রহীতাদের কাছে। ফলে তাঁদের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় তুলনামূলকভাবে বেশি।

তবে অন্য চিত্রও আছে। বিভিন্ন ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অনেকেই ঋণের চক্রে বন্দী হয়ে আছেন এবং বেশি সুদের কারণে তাঁরা একটি সংস্থার ঋণ শোধ করতে অন্য এক বা একাধিক সংস্থার শরণাপন্ন হতে বাধ্য হচ্ছেন। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য তারা ঋণদানকারী সংস্থাগুলোকে আরও বেশি দরিদ্র-সহায়ক হওয়ার কথা বলেছেন।

ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্স (আইএনএম) ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে গবেষণা করে, আবার প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশিক্ষণও দেয়। সংস্থাটির প্রথম নির্বাহী পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের সাবেক শিক্ষক এম এ বাকী খলীলী। যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘সময়টা এখন খারাপ। একদিকে বন্যা, আরেকদিকে ব্যাংকের সুদের হার এখন বেশি। ফলে ২৪ শতাংশ সেবা মাশুল বেশি না কম, তা হলফ করে বলা যাবে না। তবে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে এ হার আরেকটু কম হওয়ার সুযোগ আছে। ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার কথা যদি ভাবা হয়, সে ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যয় সাশ্রয়ী হতে হবে এবং তাদের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটাতে হবে।’