বাঁ থেকে নাহিদ ইসলাম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, আখতার হোসেন, আবু বাকের মজুমদার, নুসরাত তাবাসসুম | ছবি: সংগৃহীত

সালমান তারেক শাকিল ও আবিদ হাসান: চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনের প্ল্যাটফর্মের নাম ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ (বিবিএ)। আন্দোলন চালিয়ে নিতে গত ৮ জুলাই ৬৫ সদস্যের একটি কমিটি দেয় শিক্ষার্থীরা। কমিটিতে ২৩ জন সমন্বয়ক ও ৪২ জন সহ-সমন্বয়ক রয়েছেন। এই কমিটির সদস্যদের নিয়ে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর ‘অনুসন্ধান’ অব্যাহত রয়েছে।

গত ১২ জুলাই থেকে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতায় দেড়শ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে সরকার, তবে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে এ সংখ্যা দুই শতাধিক বলে দাবি করা হয়েছে। এছাড়া হাজারেরও বেশি আহত হয়েছে বলেও খবর প্রকাশিত হয়েছে। মেট্রোরেল স্টেশন, বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, সেতু ভবনসহ সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়েছে। এসব নাশকতার পেছনে প্রধানত কারা জড়িত ও কারা উসকানি দিচ্ছে— বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে কমিটির সদস্যদের রাজনৈতিক পরিচয় বা নেপথ্য খুঁজে দেখেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে শুক্রবার সন্ধ্যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘এই সহিংসতার পেছনের মূল হোতা তারেক রহমান। তার পরিকল্পনা সরকার উৎখাতের। আজকে থেকে জামায়াতও যুক্ত হলো। বাম, ডানও একত্র হলো। জামায়াত নিষিদ্ধের পর রিঅ্যাকশনটাও দেখা গেলো।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা দুইভাবে এটিকে (চলমান পরিস্থিতি) মোকাবিলা করবো। কাল থেকে আওয়ামী লীগও রাজপথে থাকবে। রাজনৈতিক ও আইনগত— উভয় দিক থেকেই এই সমস্যা মোকাবিলা করা হবে।’

একটি প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, “কোটা সংস্কার আন্দোলনের শুরু থেকে পেছন থেকে একজন ‘বুদ্ধিমান তরুণ’ গভীরভাবে আন্দোলনে যুক্ত” বলে তাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক এই তরুণের সঙ্গে একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক ও দেশের খ্যাতনামা একজন চিন্তকের যুক্ততাও গভীরভাবে খুঁজে দেখা হচ্ছে।

অনুসন্ধান অব্যাহত থাকায় গোয়েন্দাসূত্রটি ওই তরুণের নাম ও পরিচয় জানাতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। পরে কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত ও বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলাপকালে এ বিষয়ে আভাস পাওয়া গেছে।

কাছে অংশীজনেরা পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছা প্রকাশ করে উল্লেখ করেছেন, ‘সম্ভাব্য এই তরুণ বুদ্ধিমান  ছাত্রজীবনে সদ্য নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘ছাত্রশিবিরের’ সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সেখান থেকে বহিষ্কৃত হওয়ার পর তিনি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় মনোযোগী হন, করেন সিনেমা বিষয়ক ম্যাগাজিনও। তার বাবা চট্টগ্রাম বিভাগের বিএনপির একটি দায়িত্বশীল পদে নিযুক্ত। তার ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদলের হল কমিটিতে ছিলেন, বর্তমানে প্রবাসে রয়েছেন।

কোটা সংস্কার আন্দোলনে যুক্ত গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির একাধিকসূত্র জানায়, বর্তমানে গ্রেপ্তার, গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন ‘বুদ্ধিমান ওই তরুণের’ পরামর্শেই ২০২০ সালের ৭ অক্টোবর বুয়েটের শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎ কৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নিহত আবরার ফাহাদের স্মরণে ‘আগ্রাসন বিরোধী আট স্তম্ভ’ নির্মাণ করেছিলেন। ওই স্তম্ভটির ডিজাইনারও ছিলেন ‘বুদ্ধিমান ওই তরুণ’।

চলমান আন্দোলনের কর্মসূচির নামকরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় ওই ‘বুদ্ধিমান তরুণের’ ভূমিকা রয়েছে, বলে জানা গেছে বিশ্বস্তসূত্রে।

বাঁ থেকে সারজিস আলম, আরিফ সোহেল জাহাঙ্গীর, রাফিয়া রেহনুমা হৃদি | ছবি: সংগৃহীত

উল্লেখ্য, এ বছর কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু হওয়ার আগে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ‘ভারত ইস্যু ও খালেদা জিয়ার মুক্তির লক্ষ্যে’ কর্মসূচি দেওয়ার আলোচনা প্রায় চূড়ান্ত ছিল। পরে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর দাবি ও কর্মসূচিগুলো স্তিমিত হয়ে পড়ে।

ইতোমধ্যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের সহিংসতায় যুক্ত থাকার অভিযোগে বিএনপি, গণঅধিকার পরিষদ, এবি পার্টি, জাতীয় পার্টি (বিজেপি), গণঅধিকার পরিষদসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের নেতাদের আটক করেছে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী। এরমধ্যে বিএনপির ৯ হাজারের বেশি নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে, বলে মিডিয়া উইং সূত্র জানায়।

সমন্বয়কেরা কে কোন দলের
কোটা সংস্কার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া সমন্বয়ক ও সহ-সমন্বয়কদের মধ্যে তিনটি সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এরমধ্যে প্রাধান্য রয়েছে গত বছরের ৪ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সামনে এক সংবাদ সম্মেলনের মধ্য দিয়ে গঠিত ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’র সদস্যদের। ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেনকে আহ্বায়ক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. নাহিদ ইসলামকে সদস্য সচিব করে ৩১ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি করেছিল সংগঠনটি।

ছাত্রশক্তির সবাই আগে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের সংগঠন ছাত্র অধিকার পরিষদের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। পরে ২০২৩ সালে ৩ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অংশটি গঠনতন্ত্র-বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগ একযোগে পদত্যাগ করে। এরপর ৪ অক্টোবর ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক আখতার হোসেনের নেতৃত্ব নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি। সেখানে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন নাহিদ ইসলাম।

আন্দোলনের সমন্বয়কদের মধ্যে না থাকলেও কোটা সংস্কারের দাবিতে বিভিন্ন বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির আহ্বায়ক আখতার হোসেন। তিনি সমন্বয়ক প্যানেলে না থাকলেও আন্দোলনকারীদের নানা পরামর্শ দিতেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়।

আন্দোলনকারীদের প্রথমে চার দফা দাবি ছিল, পরে সেখান থেকে সরে এসে জাতীয় সংসদে আইন পাস করে কোটা সংস্কারের দাবিতে এক দফা দাবি নিয়ে আন্দোলন শুরু করেন তারা। এই পরামর্শ আন্দোলনকারীদের আখতার হোসেন দিয়েছেন, বলে জানা যায়।

এ বিষয়ে কথা বলতে সমন্বয়কদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি। যদিও গত ৭ জুলাই বিকাল সোয়া পাঁচটার দিকে অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেছিলেন,  ‘আমরা এই আন্দোলন সাংগঠনিক কোনও জায়গা থেকে করছি না। এটা একটা ওপেন প্ল্যাটফর্ম। সবাই এখানে যুক্ত হচ্ছে, হবে। আমাদের আন্দোলনে অনেকে আছে, যাদের কেউ কেউ ছাত্রলীগের রাজনীতিও করেছেন। আমরা দলীয় পরিচয়ে আসিনি। চাকরিতে বৈষম্য নিরসনের জন্য ‘ওপেন প্ল্যাটফর্ম’-এর মাধ্যমে দাবি জানাচ্ছি।’

২৩ জনের মধ্যে ১০ জন সমন্বয়ক ছাত্রশক্তির বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা। তারা হলেন- ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় সদস্যসচিব নাহিদ ইসলাম; তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী। যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুল্লাহ আল গালিব; তিনি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। আরেক কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফ সোহেল জাহাঙ্গীর (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)।

ছাত্রশক্তির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-আহ্বায়ক নুসরাত তাবাসসুম;  রাফিয়া রেহনুমা হৃদি ও আহ্বায়ক সদস্য সোহাগ মিয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আহ্বায়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, ও যুগ্ম-আহ্বায়ক আব্দুল কাদের, সদস্যসচিব মো. আবু বাকের মজুমদার ও যুগ্ম সদস্যসচিব আব্দুল হান্নান মাসুদ। এদের সবাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।

গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তির বাইরে আরও দুটি সংগঠনের নেতা রয়েছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সমন্বয়ক হিসেবে। সমন্বয়কদের মধ্যে প্রথম সারিতে থাকা সারজিস আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমর একুশে হল ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে ২০১৯ সালের ডাকসু নির্বাচনে সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। তার ফেসবুক আইডিতে ‘কিছু মানুষ ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা নিয়ে কথা বলছেন৷ সে বিষয়ে কিছু কথা’ শীর্ষক স্ট্যাটাসে তিনি উল্লেখ করেছেন, ২০২২ সালের এপ্রিলে তিনি ছাত্রলীগের রাজনীতি থেকে সরে আসেন।

প্রসঙ্গত, বৃহস্পতিবার ডিবি হেফাজত থেকে মুক্ত হওয়া সারজিস আলম তার নিজের ও আটক থাকা ছয়জনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তাদের প্রসঙ্গে ফেসবুকে বিস্তারিত স্ট্যাটাস দেন। এরপর থেকে তার প্রচলিত আইডিটি পাওয়া যাচ্ছে না। এরপর তার নামে আরও কয়েকটি আইডি খোলা হয়েছে বলে আন্দোলনে যুক্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

আরেক সমন্বয়ক উমামা ফাতেমা; বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সদস্য সচিব। জোনায়েদ সাকি নেতৃত্বাধীন গণসংহতি আন্দোলনের সহযোগী এই ছাত্র সংগঠনটির নেতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের শিক্ষার্থী।

গত ৭ জুলাই সঙ্গে আলাপকালে উমামা ফাতেমা বলেন, ‘ন্যায্য আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল যেকোনও সংগঠন সক্রিয় সমর্থন দেয়। কোটা আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।’

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটিতে ২৩ সদস্যের সমন্বয়ক ও ৪২ সদস্যের সহ-সমন্বয়ক রয়েছেন। এরমধ্যে সহ-সমন্বয়ক রিফাত রশীদ, হাসিব আল ইসলাম, আব্দুল্লাহ সালেহীন অয়ন, নিশিতা জামান নিহা গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির আহ্বায়ক সদস্য। বাকি সহ-সমন্বয়কদের বিষয়ে বিস্তারিত খোঁজ নেওয়া সম্ভব হয়নি।