সামাজিক মাধ্যমে বানভাসি মানুষের জন্য অফুরান ভালোবাসা

বন্যার্তদের সহায়তার জন্য যে যা পারছেন, তাই নিয়ে ছুটছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে। সেখানে ত্রাণ সংগ্রহ কেন্দ্রে জমা দেওয়ার জন্য দুই কার্টনে ভরে জিনিসপত্র নিয়ে এসেছেন এই নারী। আজ শুক্রবার বিকেলে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

আশীষ উর রহমান: তুমুল বৃষ্টি আর বাঁধভাঙা বন্যার তোড়ে প্লাবিত দেশের পূর্বাঞ্চল। কালবিলম্ব না করে মানবতার চিরন্তন হৃদয়াবেগ নিয়ে দুর্গত মানুষের বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন দেশের ছাত্র-জনতা। সর্বস্তরের মানুষ অতীতের মতোই একতাবদ্ধ হয়েছেন সব মতভেদ, বিবাদ–বিসংবাদ ভুলে। সর্বশক্তি নিয়ে দেশের এই ভয়ানক প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নেমেছেন। যে যেভাবে পারছেন—অর্থ, খাদ্য, বস্ত্র, চিকিৎসা, উদ্ধার, আশ্রয়, শুশ্রূষা দিয়ে, কায়িক শ্রম দিয়ে ত্রাণকাজে সহায়তা করছেন। তাঁরা বলছেন, এই ঐক্যই দুর্যোগ–দুর্বিপাক থেকে বিপদগ্রস্ত মানুষকে উদ্ধারের প্রধান শক্তি।

দুর্যোগ–দুঃসময়ে ঐক্যবদ্ধভাবে বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়ানোর মহৎ গুণটি এ দেশের মানুষ রপ্ত করেছেন অনেক আগেই। সিডর, আইলা থেকে শুরু করে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, শৈত্যপ্রবাহ কিংবা অগ্নিকাণ্ড, ভবনধস এমনকি মহামারির সময় সর্বস্তরের মানুষ আপনাপন সাধ্যানুযায়ী মানবিক কাজে সক্রিয় থেকেছেন। সবাই মিলে দুর্যোগ অতিক্রম করে জীবনের বুনিয়াদ অব্যাহত রাখতে অবদান রেখেছেন।

এবারও দেশের পূর্বাঞ্চলে বন্যায় তার ব্যত্যয় হয়নি। রাজধানীসহ সারা দেশে পথে পথে দেখা যাচ্ছে ত্রাণ সংগ্রহের কাজ। তবে এখন ত্রাণ তহবিল ও অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ, ত্রাণকাজে নানা রকম উপকরণ দান ও সরাসরি অংশ নিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বড় ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ফেসবুক ত্রাণকাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের যোগাযোগ, অভিজ্ঞতা বিনিময়, পরামর্শ, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ও সংগ্রহের অন্যতম মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

ফেসবুকের বুক ভরা এখন ত্রাণকাজের ছবি, ভিডিও আর এ–সংক্রান্ত হরেক রকম আবেদনে। বিভিন্ন গ্রুপ, সংগঠন, সংস্থা, প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তিগত উদ্যোগেও মানুষ এই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তুলে ধরেছেন তাঁদের আহ্বান, অনুরোধ, অভিমত, অভিজ্ঞতা। মুঠোফোন নম্বর, ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর, যোগাযোগের ঠিকানা—এসব তুলে দিচ্ছেন। মানুষ তাতে সাড়াও দিচ্ছেন।

অন্য সব বিষয়–আশয়, পরস্পর বিবাদ–বিষোদ্‌গার এমনকি পাকিস্তানের সঙ্গে টাইগারদের টেস্ট ম্যাচের বিষয়টিও গৌণ হয়ে গেছে ফেসবুকে। ফারদিন হাসান নামের একজন ফেসবুকে লিখেছেন, ‘পুরা ফেসবুক ওয়ালে খেলা নিয়ে একটা পোস্টও দেখলাম না। সবার চিন্তা কেবল বন্যা ও ভারতের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে। আমার দেশটা আসলেই বদলে গেছে, আমার দেশের মানুষ দেশ নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে! এই দেশ আর যা–ই হোক, বিপথে যাবে না।’

অনেকে নানাভাবে সহায়তা করছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে ত্রাণকেন্দ্র খোলা হয়েছে বলে পোস্ট দিয়েছেন সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত সেখানে ১৪ লাখ ৬০ হাজার টাকা তহবিল ও ত্রাণসামগ্রী পাঠানো হয়েছে বলে তিনি ফেসবুকে জানিয়েছেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘লজিস্টিকস এরিয়া রিলিফ ফান্ড’, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পক্ষ থেকে ফেসবুকে ত্রাণ সংগ্রহের কাজ চলছে বলে আহ্বান জানানো হয়েছে। বিমান ও নৌবাহিনীরও ত্রাণকাজের এমন উদ্যোগ রয়েছে।

কত মানুষ কতভাবে যে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন! ব্যক্তিগতভাবে আমজাদ খান নামের একজন তাঁর মুঠোফোন নম্বর দিয়ে জানিয়েছেন, ৪৫০ টাকা দামের লাইফ জ্যাকেট তিনি উদ্ধারকর্মীদের ১৫০ টাকায় দিচ্ছেন। ইমাম হোসেন নামের আরেকজন লিখেছেন, ত্রাণসামগ্রী, নৌকা বা স্পিডবোট পরিবহনের জন্য তাঁর দুটি ট্রাক নিয়োজিত রয়েছে।

ছাগলনাইয়ার মিশু মজুমদার ফেসবুকে লিখেছেন, ছাগলনাইয়া বাজার তাঁদের মিশু ফিলিং স্টেশন থেকে ত্রাণকাজে ব্যবহৃত যানবাহনের জন্য বিনা মূল্যে জ্বালানি তেল দেওয়া হচ্ছে। আজ সকালে ফেসবুকে মিশু মজুমদারের দেওয়া নম্বরে ফোন করলে তিনি বলেন, তাঁদের ফিলিং স্টেশনটি পানিতে ডুবে গেছে। সেখানে ২৬ হাজার লিটার তেল ছিল। তার মধ্য থেকে মাত্র দেড় হাজার লিটার তেল উদ্ধার করতে পেরেছেন। তিনি বিনা মূল্যে এই তেল ত্রাণকাজের জন্য দান করেছেন। ত্রাণকর্মীরা ফিলিং স্টেশনে গেলে তাঁদের জ্বালানি তেল দেওয়া হচ্ছে।

চট্টগ্রামের এইচ এম অ্যাগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠান তাদের ফেসবুক পেজে উল্লেখ করেছে, তাদের খামারে গবাদিপশু রাখার ব্যবস্থা আছে। ফেসবুক পেজে যোগাযোগ করে ত্রাণকর্মীরা তাঁদের খামারে দুর্গতদের গবাদিপশু বিনা খরচায় রাখতে পারবেন।

‘একুশে পরিবহন’ নামের একটি পরিবহন সংস্থা ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছে, ত্রাণকর্মীরা রাজধানীর মানিকনগরে তাঁদের কাউন্টার থেকে লাকসাম, চৌমুহনী, নোয়াখালী রুটে বিনা ভাড়ায় যাতায়াত করতে পারবেন।

‘চাঁদাবাজি নিবারণ রেসপন্স টিম’ নামের একটি দল লিখেছে, তারা পাঁচটি স্পিডবোট নিয়ে ত্রাণকাজে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার দুটি স্পিডবোট নিয়ে ফেনী চলে গেছে তাদের দুটি দল।

‘স্মাইল বাংলাদেশ’ নামের স্বেচ্ছাসেবীদের একটি দল জানিয়েছে, তারা পাঁচটি বড় কাভার্ড ভ্যান সংগ্রহ করেছেন ত্রাণসামগ্রী পাঠাতে। ফোন নম্বর দিয়ে আহ্বান জানিয়েছেন আগ্রহীরা ত্রাণ পাঠাতে চাইলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

ত্রাণকাজে নেমেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ, ঢাবি পরিবার, বিভিন্ন বিভাগ। দীপ সাহা নামের এক শিক্ষার্থী লিখেছেন, ‘জগন্নাথ হলের সরস্বতী পূজার জাঁকজমক আর বাজেট বাংলাদেশের কে না জানে, প্রায় ৮০টি মণ্ডপে একসঙ্গে পূজা হয়। সবচেয়ে সুন্দর বিষয়টা হচ্ছে, প্রায় প্রতিটা মণ্ডপ থেকেই পূজার বাজেটের একাংশ বন্যার্ত মানুষদের সহায়তার জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

একইভাবে সুরেশ নামের একজন লিখেছেন, খাগড়াছড়িতে বৌদ্ধভিক্ষুরা ত্রাণকাজে অংশ নিচ্ছেন। দীঘিনালা, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে তাঁরা তিনটি কমিটি করে কাজ করছেন।

বরিশালের অয়ন চক্রবর্তী লিখেছেন, চক্রবর্তী বাড়ির দুর্গামন্দিরে এবার দুর্গাপূজার বাজেটের একটি অংশ বন্যাদুর্গতদের জন্য ব্যয় করা হচ্ছে। এটা মোটেও দান নয়, এটা বন্যার্ত মানুষের অধিকার।’

আরেকজন লিখেছেন, ‘ওমরা করার জন্য জমানো ১৪ হাজার ৫০০ টাকা বন্যার্তদের দিয়ে আনন্দিত।’

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর সুপরিচিত আবাসিক হোটেল ও রেস্তোরাঁ ‘ক্যাফে হামিদা’ দুর্গত মানুষের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে খুলে দিয়েছেন মালিক ব্যারিস্টার আশরাফউদ্দিন। ফেসবুকে দেওয়া তাঁর নম্বরে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, হাটহাজারী, ফটিকছড়ি, রাউজান—এসব এলাকার মানুষের আশ্রয়ের জন্য তিনি হোটেলটি খুলে দিয়েছেন। হোটেলে প্রায় ১০০ জনের ধারণক্ষমতা আছে। তবে দুর্যোগের সময় প্রায় ১৫০ মানুষ থাকতে পারবেন।

জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, ব্র্যাক, বিউইপি, এআইইউবিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা গ্রুপ করে ত্রাণকাজে অংশ নিচ্ছেন। অংশ নিচ্ছে জনপ্রিয় মাধ্যম মিম সৃষ্টিকারীদের সংগঠন ‘স্বাধীন বাংলা মিমার্স সংঘ’, ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিল’, চিকিৎসকদের সংগঠন, ‘স্বেচ্ছা রক্তদান সংস্থা সন্ধানী’সহ অসংখ্য সংগঠন।

দেশে দুর্যোগ–দুর্বিপাক আসতেই পারে। সামাজিক মাধ্যমে এসব উক্তি, এসব ছবিই কিন্তু বলে দিচ্ছে, সম্মিলিত মানুষের বিপুল চেষ্টায় মাথা তুলে দাঁড়াবে বাংলাদেশ।