পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকার ক্ষুদ্রঋণ, কাজ করছে ৭২৪টি প্রতিষ্ঠান

ফখরুল ইসলাম: ৫০ বছর আগেও দেশে ‘ক্ষুদ্রঋণ’ শব্দটি খুব বেশি পরিচিত ছিল না। প্রচলিত ছিল, ঋণ, ধার, দেনা, কর্জ, হাওলাত ইত্যাদি শব্দ। ব্যাংক-ব্যবস্থায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর প্রবেশাধিকার তখন ছিল না বললেই চলে। যদিও চড়া সুদে মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নেওয়ার প্রচলন ছিল। তবে কম বা বিনা সুদে প্রতিবেশী বা বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে মানুষ বেশি ঋণ নিতেন।

বিশ্বে আধুনিক ক্ষুদ্রঋণের জনক বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক বিশেষ আইনবলে যাত্রা শুরু করে ১৯৮৩ সালে। এ গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে বহুমাত্রিক সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লবের সূচনা হয়। এ জন্য ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারও পান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ব্যাংকার টু দ্য পুওর বইয়ে উল্লেখ করেছেন, এক নারীর সঙ্গে দেখা হয় তাঁর, যিনি বাঁশ দিয়ে চেয়ার বানান। দিনে ২০ টাকা আয় হয় তাঁর চেয়ার বিক্রি করে। আয় কম হওয়ার কারণ, বাঁশ এনে দেওয়া ব্যক্তিকেই তাঁর আয়ের একটা বড় অংশ দিয়ে দিতে হয়। ড. ইউনূসের উপলব্ধি হচ্ছে, প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে উদ্যোক্তা। ওই নারী যদি নির্ভর করার মতো কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ পান, তবে স্বনির্ভর হতে পারবেন। এ উপলব্ধি থেকেই তিনি গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন।

ক্ষুদ্রঋণের মূল ধারণাটি হচ্ছে, দরিদ্র ব্যক্তিদের কিছু টাকা ঋণ দেওয়া। সেই টাকায় তাঁরা ছোট আকারে ব্যবসা শুরু করবেন। ব্যবসার মুনাফা থেকে ঋণের টাকা ফেরত দেবেন প্রতিষ্ঠানকে। প্রতিষ্ঠান আবার ওই টাকা ঋণ দেবে অন্য কাউকে। এভাবেই বিষয়টি দারিদ্র্য বিমোচনে ভূমিকা রাখবে। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে মুহাম্মদ ইউনূসের সমসাময়িক কাজ করেন ব্র্যাকের স্যার ফজলে হাসান আবেদ ও আশার প্রতিষ্ঠাতা মো. সফিকুল হক চৌধুরী। তারপর অন্যরাও এগিয়ে আসেন।

দেশের ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম দেখভালে বহু বছর কোনো নিয়ন্ত্রক সংস্থা ছিল না। প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই ২০০৬ সালে গঠিত হয় মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (এমআরএ)। এ সংস্থার সনদ ছাড়া বর্তমানে কেউ ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম চালাতে পারেন না। ২০২৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এমআরএ ৮৮২টি প্রতিষ্ঠানকে সনদ দিয়েছে। আর বাতিল করেছে ১৫৫টি সনদ। বর্তমানে সংস্থাটির কাছ থেকে সনদ নেওয়া প্রতিষ্ঠান ৭২৪টি। এসব প্রতিষ্ঠানের সদস্য ৪ কোটি ১৯ লাখ।

এমআরএর তথ্য অনুযায়ী, গত ৩০ জুন পর্যন্ত ক্ষুদ্রঋণের প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া সদস্য ৩ কোটি ২৩ লাখ, যাঁদের মধ্যে ৩ কোটি ১৮ লাখই নারী। প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে ২ লাখ ৬৩ হাজার ৮২৪ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন সদস্যরা। আর ফেরত দিয়েছেন ২ লাখ ৬১ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। সদস্যদের সঞ্চয় স্থিতি আছে ৬৬ হাজার ৮৭৬ কোটি টাকা। আর ঋণস্থিতি আছে ১ লাখ ৫৬ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা।

ব্র্যাক, আশা, বুরো বাংলাদেশ, টিএমএসএস, এসএসএস, সাজেদা ফাউন্ডেশন, উদ্দীপন, জাগরণী চক্র ফাউন্ডেশন, পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন, শক্তি ফাউন্ডেশন—এ ১০টি দেশের শীর্ষ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান। শীর্ষ ১০টির মোট সদস্য ২ কোটি ৪৮ লাখ, যাঁদের মধ্যে ১ কোটি ৯৩ লাখ ৪৮ হাজার ঋণগ্রহীতা সদস্য। ক্ষুদ্রঋণ গ্রাহকদের ৯০ দশমিক ৫৪ শতাংশই নারী।

এমআরএর এক্সিকিউটিভ ভাইস চেয়ারম্যান মো. ফসিউল্লাহ বলেন, প্রান্তিক মানুষের ঋণ পাওয়ার জন্য ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের বিকল্প নেই। প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ঋণ দেয় না, সামাজিক কার্যক্রমও করে। দারিদ্র্য বিমোচন ও কর্মসংস্থান তৈরিতে ক্ষুদ্রঋণ কী ভূমিকা রাখছে, এ খাতের মোট পরিসংখ্যানই তা বলে দিচ্ছে। চার কোটির বেশি মানুষ ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর সদস্য। আর এমন প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা কোনো কোনো ব্যাংকের চেয়ে বেশি ঋণ দিচ্ছে।

গ্রামীণ ব্যাংকসহ আরও যাদের ক্ষুদ্রঋণ
এমআরএর সনদ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের বাইরেও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম রয়েছে দেশে। বিশেষ আইনে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক একটি ব্যাংক হলেও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করে ব্যাংকটি। এমআরএর ২০২৩ সালের তথ্য অনুযায়ী, গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ১ কোটি ৩ লাখ ৬০ হাজার জন। এর মধ্যে ৭১ লাখ ৬০ হাজার ঋণগ্রহীতা সদস্য ঋণ নিয়েছেন ২৪ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। সদস্যদের ঋণের স্থিতি ১৬ হাজার ১৫০ কোটি টাকা আর সঞ্চয় স্থিতি ২২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা।

সরকারের বিভিন্ন দপ্তর, প্রতিষ্ঠানেরও বিশেষ কিছু কর্মসূচি আছে ক্ষুদ্রঋণের। সংস্থাগুলো হচ্ছে পল্লী উন্নয়ন বোর্ড, সমাজসেবা অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর, জাতীয় মহিলা সংস্থা ইত্যাদি।

ঋণগ্রহীতার সংখ্যার ভিত্তিতে এমআরএ অতি বৃহৎ, বৃহৎ, মাঝারি ও ছোট—এ চার ভাগে ভাগ করেছে প্রতিষ্ঠানগুলোকে। ৫ লাখের বেশি গ্রাহক থাকলেই অতি বৃহৎ, এ তালিকায় আছে ব্র্যাক, আশাসহ সাতটি প্রতিষ্ঠান। শুরুর দিকে বৈদেশিক তহবিলের ওপর বেশি নির্ভরশীল ছিল ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমানে দেশীয় উৎসনির্ভর।

ইনস্টিটিউট অব মাইক্রোফিন্যান্সের (আইএনএম) সাবেক নির্বাহী পরিচালক এম এ বাকী খলীলী বলেন, মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) ক্ষুদ্রঋণ খাতের অবদান ১২ থেকে ১৩ শতাংশ। আর গ্রামীণ অর্থনীতিতে এ খাতের অবদান ১৫ থেকে ১৮ শতাংশ। ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো শুধু ঋণ কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বছরে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকার ঋণ কার্যক্রমের বহুমাত্রিক প্রভাব রয়েছে। নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা, রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনগুলোতে সদস্যদের অংশগ্রহণসহ দারিদ্র্য বিমোচনের অন্যতম হাতিয়ার ক্ষুদ্রঋণ।