বন্যাপীড়িত আলেয়া বেগম (বাঁয়ে) ও তাঁর শাশুড়ি সালেহা বেগম। গতকাল সকালে ছাগলনাইয়ার ইউনিয়ন সমিতি বাজারে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি ফেনী: সত্তরোর্ধ্ব সালেহা বেগম ও পুত্রবধূ আলেয়া বেগম (৪৫) তিন দিন ধরে পানিবন্দী ছিলেন। কোনো রকমে প্রতিবেশীর পাকা বাড়ির ছাদে আশ্রয় নেন তাঁরা। নাওয়া-খাওয়া কিছুই হয়নি। শুধু পানি পান করে ছিলেন। পরে গতকাল শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে স্থানীয় লোকজন তাঁদের উদ্ধার করেন।
সালেহা বেগম ও আলেয়া বেগম ফেনীর ছাগলনাইয়া উপজেলার ১০ নম্বর ঘোপাল ইউনিয়নের নিজকুনজরা এলাকার বাসিন্দা। উদ্ধার হওয়ার পর ইউনিয়নের সমিতি বাজার এলাকায় তাঁদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বন্যার পানিতে ভিজে জবুথবু হয়ে একটি সড়কের পাশে বসে ছিলেন তাঁরা। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মীরা তাঁদের বিস্কুট ও পানি পান করতে দিয়েছিলেন।
ক্লান্ত ও ভাঙা স্বরে সালেহা বেগম স্থানীয় ভাষায় বলেন, ‘ও মা গো মা, এত পানি কুন থে আইলো! বড় বাঁচা বাঁচ্ছি।’ এটুকু বলেই হাঁপাচ্ছিলেন।
তাঁর পাশে থাকা আলেয়া বেগম দুর্দশার বিবরণ দিলেন। তিনি বলেন, বুধবার সকাল থেকে তাঁদের এলাকায় পানি ঢোকা শুরু হয়। তখনো অবশ্য তাঁরা বুঝতে পারেননি রাতের মধ্যে সবকিছু ডুবে যাবে। কারণ, এ রকম পানি কখনো হয়নি।
আলেয়া বেগমের ভাষ্য, রাতের বেলা প্রবল বেগে পানি এসে টিনের চালা আর বেড়ার ঘরটি ডুবিয়ে দেয়। মুহূর্তের মধ্যে পানি হাঁটু থেকে কোমর, কোমর থেকে গলা অবধি উঠে যায়। তাঁরা প্রাণ বাঁচাতে আশ্রয় নেন প্রতিবেশীর বাড়ির ছাদে। গত দুই দিন কোনো খাবার ছিল না। শুধু পানি পান করে টিকে ছিলেন।
আলেয়া বেগম বলেন, ‘পানির সঙ্গে এ যুদ্ধ আর করি নাই। মনে হইছিল বাঁচব না। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। কেউ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি নাই। স্বামী ও ছেলেরাও দূরে থাকায় বাড়িতে পৌঁছাতে পারেনি।’
কাজের সূত্রে আলেয়া বেগমের স্বামী থাকেন চট্টগ্রামে আর দুই ছেলে থাকেন মিরসরাইয়ে। শাশুড়িকে নিয়ে তিনি গ্রামের বাড়িতে থাকেন। বন্যার খবর পেয়ে তাঁরা বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেন, কিন্তু বাড়ি অবধি আসতে পারেননি। এদিকে মুঠোফোন নেটওয়ার্ক ও বিদ্যুৎ না থাকায় যোগাযোগ–বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন তাঁরা।
আলেয়া বেগম বলেন, পানি এমনভাবে বেড়েছে, তাঁদের কিছুই করার ছিল না। ভাবতেও পারেননি এমন দুর্দশার মধ্যে পড়তে হবে।
ফেনী জেলার ছয় উপজেলা গতকালও পানির নিচে তলিয়ে ছিল। পানিবন্দী হয়ে লাখো মানুষ দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন। সুপেয় পানির সংকট তীব্র হচ্ছে। উদ্ধার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিজিবি, ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। গতকাল সালেহা বেগম ও আলেয়া বেগমের মতো শত শত মানুষকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ছাগলনাইয়া উপজেলার ঘোপাল ইউনিয়নে দেড় ঘণ্টা থেকে দেখা যায়, ইঞ্জিনচালিত নৌকায় ২৪ জন নারী ও শিশুকে উদ্ধার করা হয়। ঘটনাস্থলে ছিলেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স চট্টগ্রামের উপসহকারী পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ। তিনি জানান, দুটি নৌকায় তাঁরা শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদে সরিয়ে নিয়েছেন।
‘আগে পানি খাই, তারপর কথা’
রোসনা বেগমকে স্থানীয়রা উদ্ধার করে আনেন সকাল সাড়ে ৯টায়। এরপর কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলে তিনি বলেন, ‘আগে পানি খাই। তারপর কথা। বৃহস্পতিবার রাত থেকে পানি খেতে পারি নাই।’
একটু জিরিয়ে, পানি খেয়ে ষাটোর্ধ্ব রোসনা বেগম বলা শুরু করলেন। জানালেন, সদর উপজেলার মুন্সীপাড়ায় তাঁদের বসবাস। চোখের সামনে বসতঘরটি পানির তোড়ে ভেসে গেছে। আবার নতুন করে ঘর বাঁধার সম্বল নেই।