ছাত্র ও অ্যাক্টিভিস্টরা বত্রিশের মোড়ে, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা

বত্রিশের মোড়কে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অবস্থান | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

সালমান তারেক শাকিল: আজ ১৫ আগস্ট। ১৯৭৫ সালের কালো এই রাতেই বিপথগামী সেনাসদস্যদের হাতে স্বপরিবারে হত্যার শিকার হয়েছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিগত ১৬ বছর শোকাবহে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ দিবসটিকে পালন করে এসেছে। যদিও এবার (৫ আগস্ট) দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ভিন্ন পরিস্থিতিতে শুরু হয়েছে দিবসটি।

বুধবার জাতীয় শোক দিবসের পূর্ব নির্ধারিত ছুটি বাতিল হয়েছে। আর বিকাল থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, অন্তবর্তীকালীন সরকারের কেউ-কেউসহ বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীরাও দিবসটিকে কেন্দ্র করে ‘ষড়যন্ত্রের’ অভিযোগ করে রাজপথে অবস্থান নেওয়ার কথা জানিয়েছেন।

বুধবার রাত পৌনে ১২ টার দিকে ধানমন্ডির বত্রিশের চিত্র ছিলো একেবারে নতুন। বঙ্গবন্ধুর বাড়ির উভয়পাশের রাস্তা পুলিশের ব্যারিক্যাড ও তারকাঁটায় মোড়ানো। সন্ধ্যায় অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচীর নেতৃত্বে শ্রদ্ধা জানাতে যাওয়া মানুষদের উপর হামলাও হয়েছে।

বুধবার সন্ধ্যা সোয়া ৬টায় রাসেল স্কয়ার থেকে ৩২ নম্বরের প্রবেশমুখে কাটাতারের বেড়া দেখা যায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

বুধবার রাত বারোটার দিকে বত্রিশের মোড়ে রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের অবস্থান নিতে দেখা গেছে। এই সময় এই প্রতিবেদক একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলেন। মাথায় জাতীয় পতাকা বাঁধা, হ্যান্ডমাইক নিয়ে নির্দেশনা দিচ্ছে একাধিক তরুণ। সতর্ক নজর, কখনো-কখনো স্লোগান। প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে তারা জানায়, আজ রাত থেকে বৃহস্পতিবার সারাদিনই তারা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে অবস্থান করবেন।

মাইক হাতে নির্দেশনা দেওয়া এক তরুণ জানান, মিরপুর রোডের পশ্চিম অংশে ছাত্র ও অন্যান্যরা অবস্থান নিয়েছে। বিএনপি ও দলটির অনুসারীরা মিরপুর রোডের পূর্ব অংশে নিউ মডেল হাইস্কুল এন্ড কলেজের সামনে অবস্থান করছেন।

সেখানে কথা হয় কলাবাগান থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাইদুর রহমান সাঈদের সঙ্গে। বিএনপির নেতাকর্মীদের অবস্থানের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা স্বৈরাচারি সরকার, ছাত্রজনতাকে মেরেছে, আমরা চাই না, তারা আবার অরাজকতা করুক। আমরা হিন্দুদের রক্ষা করছি। অনেকে চায়, এখানে একটা অস্থিরতা হোক। সেটা যাতে না হয় সেজন্যই এখানে অবস্থান নিয়েছি আমরা।’

সাইদুর রহমান সাঈদ আরও জানান, ১৫ আগস্ট পুরো দিন তারা বত্রিশের মোড় কে কেন্দ্র করে সক্রিয় থাকবেন।

বত্রিশের মোড়কে কেন্দ্র করে সক্রিয় ছাত্র ও অ্যাক্টিভিস্টরা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন 

বঙ্গবন্ধুর শাহাদাতবার্ষিকী উপলক্ষে অরাজকতার আশঙ্কার অভিযোগ এনে ‘জিয়ার সৈনিক, জিয়ার সৈনিক’ স্লোগানে মুখরিত বত্রিশের মোড়। ছাত্রদলের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, ধানমন্ডি বত্রিশকে কেন্দ্র করে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারাও রয়েছেন।

যদিও একজনকে ফোন করা হলে তিনি সেখানে নেই বলে এই প্রতিবেদকের কাছে দাবি করেন। ছাত্রদলের একজন নেতা জানান, বত্রিশ নম্বরে অবস্থানের জন্য কলবাগান ও ধানমন্ডি থানাধীন সকল ইউনিটকে অবস্থান করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

ধানমন্ডি বত্রিশ ছাড়াও রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বিএনপির অনুসারীদের বিক্ষোভ মিছিল করতে দেখা গেছে। কিছু-কিছু সড়কে লাঠিহাতে কিছু ছেলেদের দেখা গেছে। কিছু এলাকায় ‘জিয়ার সৈনিক-জিয়ার সৈনিক’ স্লোগান দিয়ে মিছিল করতে দেখা গেছে কিছু তরুণকে।

রাত পৌনে ১১ টার দিকে ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়িটির সামনে কাউকেই দেখা যায়নি। উভয়পাশে তারবন্দি সড়ক আর বাড়ির সামনে জ্বলছে কয়েকটি বাতি। যদিও মিরপুর রোডের অংশ ও পশ্চিম দিকে ধানমন্ডির ভেতরের সড়কটিতে অবস্থান করতে দেখা গেছে শতাধিক মানুষকে।

গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগের খবরে রাজধানীসহ সারাদেশেই আওয়ামী লীগের কার্যালয়, পুলিশের কার্যালয়, থানায় হামলা হয়। রাজধানীর বিজয় সরণীতে বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ ভাস্কর্য ভেঙে ফেলা হয়। প্রতিবাদী ছাত্রজনতা ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরটিকেও আগুনে পুড়িয়ে দেয়। ভাঙচুর, লুটপাট আর অগ্নিসংযোগে পুরোপুরি ধ্বংসস্তূপ ৩২ নম্বর। ভাঙা হয় বীরশ্রেষ্ঠদের ম্যুরালও। যদিও পরদিন কিছু শিক্ষার্থী ও জনতা বঙ্গবন্ধুর বাড়িটিকে পরিস্কার করার উদ্যোগ নেয়।

১৫ আগস্ট উপলক্ষ্যে কয়েকটি দল জানিয়েছে, ভাস্কর্য ভেঙে দিয়ে বা বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করা যাবে না।

তবে ৫ আগস্ট অভ্যুত্থানকারীদের অভিযোগ, শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ‘ফ্যাসিস্ট সরকার’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্যকে ‘শোষণের প্রতীক, দুঃশাসনের প্রতীক’ হিসেবে ব্যবহার করেছে।

প্রসঙ্গত, গত মঙ্গলবার শাহবাগে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ ১৪ ও ১৫ আগস্ট রাজধানীসহ সারাদেশে অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ওই কর্মসূচির অংশ হিসেবে নয়া পল্টনেও অবস্থান কর্মসূচি পালন করে দলটি।

একই কর্মসূচির অংশ হিসেবে বৃহস্পতিবার সকাল ১০ টা থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান ছাত্রদল। সংগঠনটি জানিয়েছে, ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডব, শাপলা চত্ত্বরে রাতের অন্ধকারে অসংখ্য নিরীহ আলেম ও মাদ্রাসা ছাত্র হত্যা, গত ১৫ বছরে অসংখ্য গুম-খুন, রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোকে দানবে পরিণত করার মাধ্যমে বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নিষ্ঠুরভাবে দমনের অভিযোগ এবং কোটা সংস্কার আন্দোলন ও নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নৃশংসতার মূল হোতা পলাতক শেখ হাসিনা ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের যথাযথ বিচারের দাবিতে’ এ কর্মসূচি পালন করবে তারা।

উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবার, আত্মীয়স্বজন হত্যাকাণ্ডের দিনটিকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরে ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট তা বাতিল করে। ২০০৮ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে ১৫ই অগাস্টকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে পুর্নবহাল করা হয়। নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বতীকালীন সরকার বুধবার দিবসটির ছুটি বাতিল করে।