বৃষ্টির ঘ্রাণ কেন এত ভালো লাগে?

বৃষ্টি হলেই ভেজার জন্য আকুল হয়ে উঠে মন। মডেল: মহুয়া মল্লিক জেবা | ছবি:মো. রবিউল ইসলাম

রাফিয়া আলম: ছেলেবেলায় বৃষ্টি হলেই ভেজার জন্য আকুল হয়ে উঠত মন। বৃষ্টির শব্দটাতেই কেমন একটা আনন্দের শিহরণ জাগত মনে। আর বৃষ্টির ঘ্রাণ? মাটির ওপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়ার পর যে মনমাতানো ঘ্রাণের সৃষ্টি হয়, সে কি আর লিখে বোঝানোর মতো বিষয়? অন্তর দিয়ে অনুভব করতে হয় সেই ঘ্রাণ। কিন্তু বৃষ্টি তো পানি। তাহলে কোথা থেকে তৈরি হয় এই ঘ্রাণ?

বিজ্ঞানীরা বলেন, বৃষ্টির ফোঁটা যখন মাটিতে পড়ে, তখন সঙ্গে খানিকটা বাতাসও বুদ্‌বুদ আকারে মাটিতে যায়। ওদিকে আবার মাটিতে বাস করা অণুজীব ‘জিওসমিন’ নামের এক পদার্থ সৃষ্টি করে। এই অণুজীব বা তাদের তৈরি করা জিওসমিন, কোনোটিই আমরা দেখতে পাই না। ধরুন, আপনার এলাকায় বৃষ্টি হচ্ছে, মাটির বুকে এসে পড়ল বৃষ্টি, সঙ্গে রইল বাতাস। মাটিতে তো অণুজীবেরা আছেই। আর আছে তাদের তৈরি করা জিওসমিন। বৃষ্টি, বাতাসের বুদ্‌বুদ, জিওসমিন—সব মিলেমিশে একাকার। তাই বৃষ্টির ফোঁটা মাটিতে পড়ার পর যখন ভেঙে গিয়ে ছোট ছোট কণা হয়ে বাতাসে ছিটে আসে, তখন সেই জিওসমিনও বাতাসে ভর করে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে। এটাই বৃষ্টিভেজা মাটির সোঁদা ঘ্রাণের উৎস। বৃষ্টির এই সোঁদা ঘ্রাণকে বলে ‘পেট্রিকর’। বৃষ্টির আগেও আর্দ্র হয়ে উঠতে পারে পরিবেশ। মাটিতে তখন জিওসমিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। সে সময়ও মাটি থেকে পাওয়া যায় এই সোঁদা ঘ্রাণ।

বৃষ্টি শুনলেই বর্ষণমুখর একটি দিনের ছবি ভেসে ওঠে। মডেল: মহুয়া মল্লিক জেবা | ছবি:মো. রবিউল ইসলাম

কোনো কোনো বিজ্ঞানী আবার বৃষ্টির ঘ্রাণের সঙ্গে গাছ থেকে নিঃসরিত রাসায়নিক উপাদানের যোগাযোগের কথাও বলেন। বৃষ্টিতে সতেজ কিংবা শুষ্ক উদ্ভিদ, যেকোনোটি থেকেই এমন উপাদান বেরিয়ে আসতে পারে। আবার বজ্রপাতের সময় সৃষ্টি হয় ওজোন গ্যাস। এর কারণেও বাতাসে ঘ্রাণ পেতে পারো।

আকাশ কালো করা মেঘে বদলে যায় প্রকৃতির রূপ, তা সে শহরেই হোক কিংবা গ্রামে। বৃষ্টি নিয়ে মানুষের মনে খেলা করে নানা অনুভূতি । মডেল: মহুয়া মল্লিক জেবা | ছবি:মো. রবিউল ইসলাম

ঘ্রাণ ছাড়া আরও যা আছে
বৃষ্টির পানি যেকোনো শক্ত জায়গায় পড়ার পর ভেঙে গিয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জলকণা সৃষ্টি হওয়ার সময় ‘চার্জড’ অর্থাৎ আয়নিত হয়। আয়নের বিষয়টা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। যেকোনো একটি পরমাণুতে ধনাত্মক (পজিটিভ) ও ঋণাত্মক (নেগেটিভ) চার্জ বা আধান থাকে সমান সমান। অর্থাৎ মোট চার্জ হয় ‘শূন্য’। কিন্তু যদি এই পরমাণুতে বাড়তি এক বা একাধিক ইলেকট্রন ঢুকে যায়, তাহলে ঋণাত্মক চার্জ বেড়ে গিয়ে ঋণাত্মক আয়নের সৃষ্টি হয়। ঠিক এর বিপরীত প্রক্রিয়ায় তৈরি হয় ধনাত্মক আয়ন; অর্থাৎ এক বা একাধিক ইলেকট্রন কোনো পরমাণু থেকে বেরিয়ে যায়। বাতাসে ঋণাত্মক আয়নের উপস্থিতিতে মন চনমনে হয়ে ওঠে বলে ধারণা করেন বিজ্ঞানীরা। কমে যায় মানসিক চাপ। সৃষ্টি হয় ভালো লাগার একটি অনুভূতি। এই আয়নের কিন্তু গন্ধ নেই। তবু তুমি পাবে ভালো লাগার পরশ। আর প্রকৃতিতে এই আয়ন কিন্তু কেবল বৃষ্টি থেকেই সৃষ্টি হয় না, গতিময় অন্যান্য জলের উৎস থেকেও হয়। সমুদ্রের ঢেউ, ঝরনার জল, শিশির, কুয়াশা—এসব থেকেও সৃষ্টি হতে পারে এই আয়ন। এসবের সংস্পর্শেও মন উদ্দীপিত হয়।

প্রকৃতির কাছাকাছি 

তবে বৃষ্টির ঘ্রাণ তোমার যতই ভালো লাগুক, বাস্তবতা হলো, বৃষ্টির সময় প্রয়োজন ছাড়া আমরা অনেকেই ঘরের বাইরে যাই না। বরং কালো হয়ে আসা আকাশ দেখে নিজেকে ঘরবন্দী করে ফেলি কিংবা ঘরবন্দী হয়ে যেতে বাধ্য হই। কিন্তু উঁচু ভবনে বসে তো আর সোঁদা মাটির ঘ্রাণ পাওয়া যাবে না। তাই বেরোতে হবে ঘরের বাইরে, যেতে হবে মাটির কাছাকাছি। প্রকৃতির নিয়মে বর্ষা আসবে, বর্ষা যাবে। কিন্তু আজকের দিনটা তো আর কখনোই ফিরে আসবে না! বৃষ্টিতে বাইরে গেলে ঠান্ডা লেগে যাওয়ার কথা ভাবছেন? এমন হলে আপনি বর্ষাতি পরে বেরোতে পারেন। নইলে বেরোতে পারেন বৃষ্টির ঠিক পরপরই। তবে বজ্রপাতের সময় অবশ্যই নিরাপদ স্থানে থাকতে হবে।

সূত্র: বিবিসি, ম্যাসাচুসেটস ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি ও রিডার্স ডাইজেস্ট