সিয়াম | ছবি: সংগৃহীত

প্রতিনিধি বগুড়া: সারা দিন কুড়িয়ে পাওয়া ভাঙাড়ি মালামাল বিক্রি করে গ্যারেজে ভ্যান রেখে ঘরে ফেরার কথা ছিল সিয়ামের। সারা দিন পেটে দানাপানি পড়েনি। তাই গ্যারেজে ভ্যান রেখে সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে গিয়েছিল রেস্তোরাঁয় ভাত খেতে। কিন্তু ভাত খাওয়া আর হয়নি তার। সড়ক পারাপার হওয়ার সময় গুলিবিদ্ধ হয় সে। স্থানীয় একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা সিয়ামকে মৃত ঘোষণা করেন।

সিয়াম নিহত হয় গত ১৯ জুলাই। তখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে জারি করা হয়েছিল কারফিউ। সন্ধ্যায় বগুড়া শহরের সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে সিয়াম গুলিবিদ্ধ হয়। পথশিশু ছিল সিয়াম। পরে সে বড় হয়েছে পালক মা–বাবার কাছে। বগুড়ার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে ময়নাতদন্তের পর সিয়ামের লাশ গ্রহণ করেন তাঁর পালক বাবা মো. আশিক।

বগুড়া শহরের হাড্ডিপট্টিতে পরিবার নিয়ে থাকেন মো. আশিক। তিনি গাড়ি চালান। গতকাল রোববার রেলওয়ে স্টেশনসংলগ্ন হাড্ডিপট্টি বস্তিতে গিয়ে কথা হয় মো. আশিক ও শাপলা খাতুন দম্পতির সঙ্গে।

মো. আশিক বলেন, ‘হামার লিজের চারডা ছোল। সিয়াম হামার লিজের ছোল লয়। সাত বছর আগে ওক হামি শহরত কুড়ে পাচি। সেই থ্যাকে বস্তিত হামার ঘরতই বড় হচে। লেকাপড়া করেনি। ভাঙাড়ি কুড়াত। সেদিনও (১৯ জুলাই) ছোলডা বিয়ানবেলা না খায়া ভাঙাড়ি কুরাবার গেচে। ভ্যানে করে সারা দিন ভাঙাড়ি কুরাচে। সন্ধ্যায় ভাঙাড়ি বেচা শ্যাষে ভ্যানডা গ্যারজত থুয়ে ভাত খাবার জন্যি আমতলা মোড়ে গেচলো। প্যাটত জোটেনি। গুলি খ্যায়াই মরচে।’

মো. আশিক আরও বলেন, ‘যখন ওক কুড়ায়ে পাচনু, তখন সিয়াম আট বছরের বাচ্চা। বাপ-মাওয়ের নাম কবার পারেনি। ঠিকানাও কবার পারেনি। পরে জানবার পারচিলাম, ওর বাড়ি বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার হাটকড়ই এলাকার দরিয়াপুর গ্রামে। বাবার নাম মৃত বাবু মিয়া। মায়ের নাম মৃত আয়েশা বেগম। মা-বাবা কেউ বেঁচে নেই।’

শাপলা বেগম বলেন, ‘সিয়াম বিয়ান বেলা ভাঙাড়ি কুড়াবার জন্যি গেচলো। ভাত খাবার যায়া গুলি খ্যায়া মরচে। লোকজন ওর লাশ হাসপাতালে পাঠায়। বস্তির কেউ একজন কচ্চে, আমতলা মোড়ে এডা ছোল গুলি খ্যায়া মরচে। দেখতে সিয়ামের মতো। পরে হাসপাতালত য্যায়া দেখি, হ, সিয়ামই তো। সারা শরীলত গুলির দাগ। চোখ–মুখ সব গুলিতে আউলে গেচে। ময়নাতদন্তের পর লাশ দেয় হাসপাতাল থ্যাকে। দাফন করা হয় নামাজগড় কবরস্থানে।’

প্রত্যক্ষদর্শী ব্যক্তিরা যা বললেন

প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা ও গুলি করে হত্যার প্রতিবাদে ১৯ জুলাই বগুড়া শহরের সাতমাথা-তিনমাথা সড়কের সেউজগাড়ি আমতলা মোড়ে বেলা তিনটার দিকে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেন ছাত্র-জনতা। প্রায় দুই ঘণ্টা সড়কে যান চলাচল বন্ধ থাকার পর পাঁচটার দিকে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাসের শেল ও গুলি ছোড়ে। থেমে থেমে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে সিয়াম রেস্তোরাঁয় ভাত খাওয়ার জন্য সড়ক পারাপার হচ্ছিল। এ সময় এলোপাতাড়ি গুলিতে সিয়াম গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায়।

পুলিশের করা মামলায় ভিন্ন তথ্য
১৯ জুলাই বগুড়া শহরের স্টেশন সড়কের আমতলা মোড় এলাকায় পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে কিশোর সিয়াম নিহতের ঘটনায় ২১ জুলাই সদর থানায় হামলা হয়েছে। উপপরিদর্শক (এসআই) জাকির আল আহসান বাদী হয়ে বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন। এতে বিএনপি ও জামায়াতের ৩৭ নেতা-কর্মীকে আসামি করা হয়।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, আসামিরা বেআইনিভাবে জনতার সঙ্গে দলবদ্ধ হয়ে অতর্কিতভাবে কর্তব্যরত পুলিশের সরকারি কাজে বাধা সৃষ্টিসহ পুলিশকে লক্ষ্য করে বেপরোয়া বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল ও বিস্ফোরকদ্রব্য ককটেল নিক্ষেপ করেন। পুলিশকে লক্ষ্য করে ছোড়া ককটেলে আসামিদের সঙ্গী সিয়ামের কপাল, মুখমণ্ডল, বুক, পেট, দুই হাত, পাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে গুরুতর জখম হয়। পরে স্থানীয় লোকজন সিয়ামকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক তাকে সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটে মৃত ঘোষণা করেন।

এ মামলার আসামি করা হয়েছে বগুড়া জেলা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নূরে আলম সিদ্দিকীকে। তিনি বলেন, সিয়াম হত্যাকাণ্ড ঘটেছে প্রকাশ্যে হাজারো ছাত্র-জনতার সামনে। কার গুলিতে মারা গেছে, সেটার ভিডিও ফুটেজও আছে। অথচ মিথ্যা তথ্য দিয়ে পুলিশ মামলায় উল্লেখ করেছে, ককটেল বিস্ফোরণে সিয়াম মারা গেছে।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা বগুড়া ডিবির পরিদর্শক মুস্তাফিজ হাসান বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হওয়া সব মামলা এক মাসের মধ্যে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের এ–সংক্রান্ত নির্দেশনা পেলে সব মামলা প্রত্যাহার করা হবে।