সিকিমে তিস্তার ওপর নির্মিত একটি বাঁধ | ফাইল ছবি: এএনআই |
প্রতিনিধি কলকাতা: ভারতের সরকারি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প পরিচালনাকারী সংস্থা ন্যাশনাল হাইড্রো-ইলেকট্রিক পাওয়ার করপোরেশন (এনএইচপিসি) জানিয়েছে, ভূমিধসের কারণে গতকাল মঙ্গলবার সিকিমের তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী একটি বাঁধ বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভিডিও চিত্র দেখা গেছে, পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা বিশাল আকারের পাথরের টুকরা বাঁধটির ওপর আছড়ে পড়ায় বাঁধ ভেঙে গেছে।
কয়েক দিন ধরেই ওই অঞ্চলে পাহাড় থেকে পাথর গড়িয়ে পড়ায় স্থানীয় বাসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। তবে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশেষ কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছে এনএইচপিসি। তারা বলছে, গত বছর হিমবাহ ভেঙে সিকিমে যে বন্যা হয়েছিল, সেই বন্যায় প্রকল্পটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তখন থেকেই এই বাঁধ বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। সেটি মেরামতের কাজ চলছিল। এই নিয়ে গত এক বছরে সিকিমে তিস্তা নদীর ওপর নির্মিত বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দ্বিতীয় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হলো।
এনএইচপিসি জানিয়েছে, ৫১০ মেগাওয়াট তিস্তা-৫ বিদ্যুতের যে কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, সেটি মঙ্গলবারের ভূমিধসে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে হাই ভোল্টেজ সাবস্টেশন। এনএইচপিসির বিশেষজ্ঞ দল পরিস্থিতি মূল্যায়ন করতে বর্তমানে প্রকল্পটি পরিদর্শন করছে।
কীভাবে ভেঙে পড়ছে পূর্ব হিমালয়
এই বাঁধ আবার সচল করতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এতে যে পরিমাণে অর্থ খরচ হবে, তা করা যাবে কি না, তা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। যদি শেষ পর্যন্ত তিস্তা পাঁচ প্রকল্প বাদ দেওয়া হয়, তবে সেটি একটি ‘জাংক’ বা অব্যবহার্য আবর্জনা হয়ে পূর্ব হিমালয়ের পাদদেশে পড়ে থাকবে? যা একদিকে দূষণ ছড়াবে এবং অন্যদিকে পরিবেশের আরও ক্ষতি করবে।
ভারতে নদী, পাহাড়, হিমবাহসহ সব পরিবেশবিশেষজ্ঞের বড় অংশ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, ধারাবাহিকভাবে নানা ধরনের নির্মাণের কারণে পূর্ব হিমালয়ের অন্তত দুটি জনবহুল জায়গা সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ও হচ্ছে। সিকিম ও উত্তর-পূর্ব ভারতে অরুণাচল প্রদেশে বিরাট সংখ্যায় খরস্রোতা পাহাড়ি নদী থাকায় সেগুলো থেকে পানি টেনে তিস্তা-৫-এর মতো অসংখ্য জলবিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করা হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে পর্যটক ও নিরাপত্তাশিবির তৈরির লক্ষ্যে পাহাড়ের পাথর কেটে বানানো হয়েছে অজস্র সরু এবং চওড়া সড়ক।
বিশেষজ্ঞরা অতীতে বলেন, এতে পূর্ব হিমালয়ের পাহাড়ের অধিকাংশই অত্যন্ত নড়বড়ে হয়ে গেছে। সেখান থেকে প্রায়ই বর্ষাকালে পাথর পড়ছে এবং পাহাড়ধস বেড়েই চলেছে। একই ঘটনা ঘটছে উত্তর-পূর্ব ভারতে তিব্বতের কোল ঘেঁষে অবস্থিত অরুণাচল প্রদেশেও।
ভূমিধসে বাসিন্দা ও পর্যটকদের বিপদ বাড়ছে
পাহাড়ধসে একদিকে স্থানীয় বাসিন্দা ও পর্যটকদের বিপদ বাড়ছ। ভারতের বিভিন্ন সংবাদপত্র জানিয়েছে, গত বছর সিকিমে হিমবাহ ভেঙে সৃষ্ট বন্যায় অন্তত ১৭৯ জনের মৃত্যু হয়েছিল। নিখোঁজ অনেকের খোঁজ এখনো পাওয়া যায়নি।
অবিরাম বর্ষার কারণে ২০২৪ সালেও সিকিম মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জুনে হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত এই রাজ্যে টানা ৩৬ ঘণ্টা প্রবল বৃষ্টির ফলে এখন পর্যন্ত ভূমিধস ও বন্যার কারণে কমপক্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। প্রায় দুই হাজার পর্যটক আটকা পড়েছিলেন। এখন পর্যন্ত চার মাসের (জুন-সেপ্টেম্বর) মধ্যে সিকিমে স্বাভাবিকের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি বৃষ্টি হয়েছে।
তিস্তা নদীর পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা চলছে। বিশেষজ্ঞদের একাংশ বিভিন্ন সময় জোর দিয়ে বলেছেন, শুধু খরার সময় পানি না পাওয়ার সমস্যা দিয়ে বিচার করলে হবে না। পুরো বিষয়টিকে একটি সামগ্রিক সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে এবং বর্ষাকালে যে উত্তরবঙ্গ ও উত্তর-পূর্ব ভারত এবং সিকিম ক্রমাগত প্লাবিত হয়ে অসংখ্য মানুষ মারা যাচ্ছেন, সেটিও মাথায় রাখতে হবে।
বড় বিপদের বিষয়টি মাথায় রেখে সিকিমের জলবিদ্যুৎকেন্দ্র ও জলাধারগুলো নিয়েও সামগ্রিকভাবে ভাবতে হবে। কয়েক মাস আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একটি চিঠিতে এই একই কথা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জানিয়েছিলেন।
মমতা সেই চিঠিতে লিখেছিলেন, সিকিমে নদীর ওপরের অংশে বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে তিস্তা থেকে জল টেনে নেওয়ার কারণেই সমতলে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাংলাদেশে জল পাঠানোর বিষয়টি অবাস্তব প্রস্তাবে পরিণত হচ্ছে। অতীতেও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তরফে এই একই কথা ভারত সরকারকে জানানো হয়েছিল।