ইসলামী ব্যাংক |
নিজস্ব প্রতিবেদক: গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর একটি গোষ্ঠী বারবার ইসলামী ব্যাংক দখলে নিতে হামলা চালিয়েছে। চলতি মাসের ৬ থেকে ১১ তারিখ পর্যন্ত পাঁচ দিনে তিনবার মতিঝিলের দিলকুশায় ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ে সশস্ত্র লোকজন ঘেরাও, হামলা ও গুলির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে। ব্যাংকটির প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও উপস্থিত নিরাপত্তারক্ষীরা মিলে প্রতিবারই এসব হামলা ঠেকিয়েছেন।
সোমবার দেশের অন্যতম বৃহৎ এ ব্যাংকটির শেয়ারহোল্ডার ও কোটি কোটি গ্রাহকের স্বার্থে নিরাপত্তা ও স্বাভাবিক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. মুনিরুল মাওলা এ অবস্থায় নিজ দপ্তরে যেতে পারছেন না। ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চরম আতঙ্কে রয়েছেন।
এদিকে ব্যাংক দখলে নিতে বিক্ষোভ, হামলা ও ভাঙচুরের মতো ঘটনাগুলোকে রোববার বাংলাদেশ ব্যাংক শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপ হিসেবে আখ্যায়িত করে একে শাস্তিযোগ্য অপরাধ ঘোষণা করে বিবৃতি দিয়েছে।
ব্যাংক এমডিদের পাঠানো এক নির্দেশে বলা হয়, ব্যাংক-কোম্পানিতে শৃঙ্খলা পরিপন্থী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে হবে।
এতে আরও বলা হয়, মালিকানা সম্পর্কিত বিরোধ নিষ্পত্তিতে আইনি প্রক্রিয়া ও নিয়মতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে। গণমাধ্যমে পাঠানো একটি কপিতে ‘জাতীয় স্বার্থে এ বিষয়ে সচেতনতা তৈরির’ অনুরোধও করা হয়েছে।
১৯৮৩ সালে প্রতিষ্ঠা হয় ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড। ১৯৮৩ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত এ দীর্ঘ সময়ে ব্যাংকটিতে একটি গোষ্ঠী একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেছিল। ২০১৩ সালের ২২ মে ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় আবু নাসের আবদুজ জাহের তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০১৫ সালের ১৩ জুন ব্যাংকটির পর্ষদ সভায় মুস্তাফা আনোয়ারকে তিন বছরের জন্য চেয়ারম্যান করা হয়। এরই মধ্যে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্যোক্তা বাহরাইন ইসলামিক ব্যাংক তাদের সব শেয়ার বিক্রি করে চলে যায়। ২০১৫ সালে আরেক উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠান দুবাই ইসলামিক ব্যাংকও সব শেয়ার বিক্রি করে দেয়। একই সময়ে উদ্যোক্তা পরিচালক ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) ৮ কোটি ৬৯ লাখ শেয়ার বিক্রি করে দেয়। কুয়েতের সরকারি ব্যাংক কুয়েত ফাইন্যান্স হাউসও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে সব শেয়ার বিক্রি করে।
২০১৬ সালের ২ জুন ব্যাংকটির ৩৩তম বার্ষিক সাধারণ সভায় নতুন শেয়ারহোল্ডার পরিচালক ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের সিদ্ধান্ত হলে মুস্তাফা আনোয়ার ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরে যান। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আবদুল মান্নান পদত্যাগ করেন। ওই সময় কমার্স ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আরাস্তু খানকে ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। এমডির দায়িত্ব পান ইউনিয়ন ব্যাংকের এমডি আবদুল হামিদ মিঞা।
এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ইতোমধ্যে সিংহভাগ শেয়ারের মালিকানা সূত্রে চট্টগ্রামভিত্তিক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ ২০১৭ সালে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নেয়। নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে আমদানি-রপ্তানি ট্রেড ও ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে বছরে আড়াই লাখ কোটি টাকার টার্নওভার রয়েছে এই ব্যবসায়ী গ্রুপটির। কয়েক যুগের পুরোনো এ ব্যবসায়ী গ্রুপের আর্থিক লেনদেন হয় দেশের ১৫টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে। এ গ্রুপের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ২০২০ সালে এমডি হিসেবে মো. মুনিরুল মাওলা দায়িত্ব নেন। তার পর থেকে ব্যাংকটি অব্যাহত অগ্রগতি অর্জন করে আসছে। সর্বোচ্চ পরিমাণ রেমিট্যান্স আহরণ, ঋণ বিতরণ ও আমানত সংগ্রহ করে ইসলামী ব্যাংক এখন দেশের শীর্ষ বাণিজ্যিক ব্যাংক। ২০২৩ সালে ব্যাংকটি মোট আমানত পেয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৫৬ কোটি টাকা। আর একই বছর ঋণ বিতরণ করেছে মোট ১ লাখ ৪১ হাজার ৩৫ কোটি টাকা। ২০২৩ সাল শেষে ঋণ বিতরণ ও আমানত প্রাপ্তি- এ দুই ক্ষেত্রেই ইসলামী ব্যাংক দেশের শীর্ষস্থানে থাকা সোনালী ব্যাংককে পেছনে ফেলে শীর্ষস্থান দখল করে।
রেমিট্যান্স সংগ্রহে আগে থেকেই ইসলামী ব্যাংক শীর্ষস্থানে ছিল। প্রতি মাসেই ব্যাংকটি ৫০০ মিলিয়ন বা ৫০ কোটি ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পেয়ে থাকে। বছর শেষে ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ বিলিয়নের মতো। এ পরিমাণ রেমিট্যান্স অন্য কোনো ব্যাংক আনতে পারেনি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত ইসলামী ব্যাংকের শাখা ছিল ৩৯৪টি। দেশের বাইরে বিশ্বের দেশে দেশে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নেটওয়ার্ক রয়েছে এ ব্যাংকটির।
ব্যাংকটির কর্মকর্তাদের অনেকের অভিযোগ, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পরিবর্তনের ডাক দেওয়ার সুযোগ নিতে চায় একটি গোষ্ঠী। এককভাবে দেশের অর্থনীতিতে নজিরবিহীন অবদান রাখা সমৃদ্ধ এই ইসলামী ব্যাংক আবারও নিজেদের কব্জায় নিয়ে ব্যাংকবহির্ভূত উদ্দশ্যে এ ব্যাংকের অর্থ ব্যবহারের পাঁয়তারা করা হচ্ছে বলেও তারা অভিযোগ করেন।