পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশতে একটি বিপণিবিতান কেন্দ্রে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ডের পেছনে রাশিয়ার হাত রয়েছে বলে সন্দেহ পোলিশ কর্তৃপক্ষের | ছবি: রয়টার্স

পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর পক্ষ থেকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলা হচ্ছে। রাশিয়া ছয় মাসের বেশি সময় ধরে ন্যাটোর সদস্যদেশগুলোতে ‘সাহসী’ নাশকতামূলক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের লক্ষ্য হচ্ছে ইউক্রেনের জন্য অস্ত্র সরবরাহে যুক্ত বিভিন্ন গুদাম, এ–সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানগুলো। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ন্যাটোর এক শীর্ষ কর্মকর্তা এসব তথ্য দিয়েছেন।

ইউরোপের একাধিক নিরাপত্তা কর্মকর্তা রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের এ ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ডকে হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তাঁরা বলছেন, রুশ গোয়েন্দারা ইউরোপের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে এড়াতে স্থানীয় লোকজনকে নিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ নানা কাজ করাচ্ছেন। তবে এ ধরনের অপরাধমূলক কাজের জন্য সহজেই রাশিয়া নিজের দায় এড়াতে সক্ষম হচ্ছে।

ন্যাটোর কর্মকর্তা বলেন, ছয় মাসের বেশি সময় ধরে তাঁরা রাশিয়ার পক্ষ থেকে একধরনের ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধের বিস্তৃতি লক্ষ করেছেন। এর মধ্যে ইউক্রেনের জন্য যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহব্যবস্থায় নাশকতার বিষয়টিও যুক্ত রয়েছে। অস্ত্র উৎপাদন, এর উৎস ও সংরক্ষণ—এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অস্ত্র পৌঁছানোর সব স্তরে এ হামলা চালানো হচ্ছে। ন্যাটোর জ্যেষ্ঠ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, রাশিয়া ন্যাটো মিত্রদের মধ্যে ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ ভীত্তিহীন বলে অস্বীকার করা হয়েছে। তবে রাশিয়ার এ ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ও ‘হাইব্রিড’ যুদ্ধকৌশলের বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসিতে অনুষ্ঠিত ন্যাটোর ৭৫তম শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে।

বিশ্লেষকেরা ন্যাটোর বিরুদ্ধে একে ক্রেমলিনের ছায়া যুদ্ধ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে ন্যাটোর সদস্যরা কতটা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানাবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ, ইউরোপের দেশগুলো মস্কোকে এ ধরনের যুদ্ধ নিয়ে অপ্রপচার চালানোর সুযোগ দিতে চায় না। এ ছাড়া ইউরোপজুড়ে নিরাপত্তা লঙ্ঘন হয়েছে, এ রকম কোনো সতর্কবার্তাও তারা জনসমক্ষে এখন আনতে চাইছে না।

ইউক্রেনে ২০২২ সালে যুদ্ধ শুরু করার পর থেকে ক্রেমলিন কীভাবে তার গোয়েন্দা কার্যক্রমের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সাম্প্রতিক কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের ঘটনায়। গত বছর ইউক্রেনের ১৪ ও বেলারুশের ২ নাগরিক পোল্যান্ডে গ্রেপ্তার হন। তাঁদের বিরুদ্ধে রাশিয়ার হয়ে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের অভিযোগ আনা হয়। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ম্যাক্সিম এল। তিনি ইউক্রেনের নাগরিক। তাঁর বয়স ২৪। তাঁর বিরুদ্ধে রাশিয়ার আন্দ্রেজ নামের এক ব্যক্তির আদেশে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালানোর অভিযোগ আনা হয়। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হয়ে তাঁর ছয় বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। ম্যাক্সিম গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আন্দ্রেজের নানা কাজ করেছিলেন। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বার্তা আদান–প্রদানের অ্যাপ টেলিগ্রামের মাধ্যমে তাঁদের মধ্যে যোগাযোগ হয়। আন্দ্রেজকে কখনো সরাসরি দেখেননি ম্যাক্সিম। তবু অর্থের বিনিময়ে তাঁর কাজ করে দিয়েছিলেন তিনি।

আন্দ্রেজের প্রথম কাজের জন্য ডিজিটাল মুদ্রায় মাত্র ৮২০ টাকা (৭ ডলার) পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন ম্যাক্সিম। তাঁর প্রথম কাজ ছিল পোল্যান্ডে যুদ্ধবিরোধী গ্রাফিতিতে রং ছড়িয়ে দেওয়া। অবশ্য পরবর্তীকালে তাঁকে অন্য কাজে লাগানো শুরু হয়।

‘সহজে অর্থ উপার্জন’
লাবলিন কারাগারে সিএনএনকে এক সাক্ষাৎকার দেন ম্যাক্সিম। তিনি বলেন, বেকারত্ব ও দারিদ্র্য থেকে বাঁচার জন্য হতাশা নিয়ে তিনি ইউক্রেন থেকে পালিয়ে পোল্যান্ডে আসেন। এখানে অর্থ উপার্জন করা সহজ ছিল। তিনি আন্দ্রেজের দেওয়া কাজ সম্পর্কে বলেন, ‘ওই সময় আমার অর্থের অনেক প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল।’

ম্যাক্সিম আরও বলেন, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার পর ইউক্রেনের পক্ষে লড়াই করার বাধ্যবাধকতা অনুভব করেননি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন আমার জন্য কখনো কিছু করেনি। আমার মনে হয় না, শুধু একটি দেশে জন্ম নিলেই এর জন্য আমাকে যুদ্ধে যেতে হবে। আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি রুশপন্থী নই। আমি ইউক্রেনপন্থীও নই। আমি কোনো পন্থী নই।’

প্রথম কাজের পর আন্দ্রেজ তাঁকে বিভিন্ন স্থানের তথ্য চাইতে থাকেন। এ ছাড়া ওই সব স্থানে নজরদারি ক্যামেরা বসাতে বলেন। এর মধ্যে ছিল সীমান্ত শহর মেদিকার রেললাইনের কাছে ক্যামেরা বসানোর কাজ। ওই সীমান্ত দিয়ে ইউক্রেনে সামরিক ও মানবিক সহায়তা যায়। ম্যাক্সিম বলেন, তাঁর কাছে এ কাজে কোনো ক্ষতি হতে পারে, তা মনে হয়নি। তাঁর কাছে এটা অনেকটাই গুরুত্বহীন কাজ মনে হয়।

এরপর ম্যাক্সিমকে পোল্যান্ডের বিয়ালা পোদলস্কায় ইউক্রেনের একটি পরিবহন কোম্পানির বেড়ায় আগুন লাগিয়ে দিতে বলেন আন্দ্রেজ। ম্যাক্সিম বলেন, তিনি এ ঘটনা ঘটানটি। তবে বেড়ার ভুয়া ছবি তুলে পাঠান।

ম্যাক্সিম পরে ধীরে ধীরে বুঝতে পারেন, আন্দ্রেজ মূলত রুশ গোয়েন্দা কর্মকর্তা। কারণ, এরপর আন্দ্রেজ তাঁকে পোল্যান্ডে প্রশিক্ষণরত ইউক্রেনীয় সেনাদের একটি ঘাঁটির বাইরে ক্যামেরা বসাতে বলেন। ম্যাক্সিম বলেন, ‘তখন আমি বুঝতে পারি, এটি গুরুতর। আমি তখন অস্বস্তিতে পড়ি। তখন আমি কাজ ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু এ সুযোগ আর আমি পাইনি। আমি পরের দিনই গ্রেপ্তার হই।’ 

২০২৩ সালের ৩ মার্চ পোল্যান্ডের নিরাপত্তা কর্মকর্তারা ম্যাক্সিমকে গ্রেপ্তার করেন। এর আগে তাঁর ওপর নজরদারি চালানো হয়। ম্যাক্সিম তাঁর কাজ করতে গিয়ে কিছুটা ভুল করে ফেলেছিলেন। তিনি একটি গ্যাস স্টেশনের বিল ফেলে রেখেছিলেন। তা থেকেই তাঁর ওপর নজরদারি শুরু হয়। এরপর আরও বেশ কয়েকটি অভিযান পরিচালনা করে পোল্যান্ডের নিরাপত্তা সংস্থা। সাম্প্রতিক সময়ে পোল্যান্ডে রুশ গোয়েন্দা কার্যক্রম ঠেকাতে এটাই ছিল সবচেয়ে বড় ধরনের অভিযান। এ ঘটনায় অভ্যন্তরীণ বিষয়ে রুশ হস্তক্ষেপ নিয়ে ওয়ারশতে উদ্বেগ তৈরি হয়। এর আগে গত আগস্টে রুশ ভাড়াটে বাহিনী ভাগনারের জন্য সদস্য সংগ্রহের অভিযোগে দুই রুশ নাগরিক গ্রেপ্তার হন। এ ছাড়া গত মে মাসে পোল্যান্ড ও বেলারুশের একজন করে নাশকতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন।

এ বছরের এপ্রিলে পোল্যান্ডের আরেক ব্যক্তিকে গোলাবারুদ রাখার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে কিয়েভে ন্যাটোর অস্ত্র স্থানান্তর করার কেন্দ্র রজেসজো জাসিওনকা বিমানবন্দরে নজরদারি করার অভিযোগ আনা হয়। এ ছাড়া ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকেও গুপ্তহত্যা চেষ্টার অভিযোগ আনা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। কারণ, ওই বিমানবন্দর প্রায়ই ব্যবহার করেন জেলেনস্কি।

ইউরোপজুড়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পোল্যান্ডের মতোই নানা কর্মকাণ্ডের অভিযোগ রয়েছে। এসব কর্মকাণ্ডকে বিচ্ছিন্নভাবে না দেখে একত্রে দেখলে মস্কোর বিশাল ছায়া যুদ্ধ বা অভিযানের ব্যাপকতা দেখা যায়।

মে মাসে পোল্যান্ডের বৃহত্তম শপিং সেন্টারে অগ্নিসংযোগের পেছনে রাশিয়ার হাত ছিল বলে অভিযোগ করেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী ডোনাল্ড টাস্ক। এ ছাড়া গত জুনে একটি অস্ত্র কারখানায় হামলার জন্যও রাশিয়া সন্দেহের তালিকায় রয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। ইউরোপের আরেক দেশ চেক রিপাবলিকের কর্মকর্তারাও গত বছর দেশটির রেলওয়ে নেটওয়ার্কে বিঘ্ন ঘটানোর পেছনে রাশিয়ার হাত রয়েছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। গত মাসে জার্মানির বার্লিনে একটি ধাতব কারখানায় আগুন লাগার ঘটনায় রুশপন্থী এক ইউক্রেনীয় নাগরিক গ্রেপ্তার হন। এ ছাড়া পূর্ব লন্ডনে একটি গুদামে বাইরের দেশের হাত রয়েছে বলে অভিযোগ আনে লন্ডনের মেট্রোপলিটন পুলিশ। তাদের সন্দেহ রাশিয়াকেই। যদিও এসব ঘটনা সরাসরি রুশ গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, তবে অপেশাদার লোকজনকে দিয়ে এসব ঘটনা ঘটানোর বিষয়টি দেখে মনে হয়, তা ভয় দেখাতে বা কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটানোর উদ্দেশ্যেই করা হয়েছে।

বেশ বিপজ্জনক খেলা
ন্যাটোর ওই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা আরও বলেন, ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোতে রুশ নাশকতার বিষয়টি ‘বেশ বিপজ্জনক খেলা’। এ ধরনের বিষয়গুলো যদিও সব সময় সামরিক সংঘাতের বাইরে পড়ে, তা ন্যাটোর আর্টিকেল ৫–এর আওতায় পড়ে না। আর্টিকেল ৫ অনুযায়ী, ন্যাটোর কোনো একটি সদস্যদেশ আক্রান্ত হলে সেটি সব ন্যাটোভুক্ত দেশের ওপর হামলা হিসেবে বিবেচনা করা হবে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের হামলার প্রকৃত উৎস কোথায়, তা খুঁজে বের করা কঠিন ও বিপজ্জনক এক হিসাব। তিনি আরও বলেন, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ইউক্রেনে হামলা দেখে মনে হয়, তিনি সব সময় ভালো উপদেশ পান না।

ওই কর্মকর্তার মতে, রাশিয়া পুরোদমে হাইব্রিড যুদ্ধকৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা ইউরোপে বড় ধরনের অভিযান থেকে শুরু করে নির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য পেতে চার লাখ ইউরো খরচ করার মতো অভিযানও দেখছি। এর বাইরে কিছু স্থানে মাত্র কয়েক শ ইউরো খরচ করে দুর্বৃত্তদের নিয়োগ করার মতো উদাহরণও দেখছি।’

রুশ সীমান্তের কাছে এস্তোনিয়াতেও এ ধরনের হুমকি বেড়ে গেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গাড়িতে হামলার সময় ১০ জন সন্দেহভাজন রুশ গোয়েন্দা গ্রেপ্তার হন। ন্যাটোর এই সদস্যদেশের পক্ষ থেকে এ কর্মকাণ্ডকে দেশটিকে অস্থিতিশীল করতে রুশ প্রচেষ্টা হিসেবে অভিহিত করা হয়।

এস্তোনিয়ার অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা সংস্থা কেএপিওর মুখপাত্র হ্যারিস পুসেপ বলেন, ‘সাম্প্রতিক মাসগুলোতে রুশ কর্মকাণ্ড বেড়ে গেছে। আমরা এখন পর্যন্ত ১০ জনকে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছি। এস্তোনিয়ার নিরাপত্তা লঙ্ঘনের চেষ্টায় হাইব্রিড কর্মকাণ্ড বাড়তে দেখা গেছে, যা অতীতে দেখা যায়নি।’

হ্যারিস পুসেপ আরও বলেন, রুশ অভিযান এখন আরও বেশি শারীরিক আক্রমণের দিকে এগিয়েছে এবং এ থেকে ধারণা করা যায়, সামনে আরও এ ধরনের আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড বাড়বে।

এস্তোনিয়ার ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের এ পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হবে। ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে রসদ জোগাড়ে রাশিয়া যথেষ্ট বড় দেশ এবং আমাদের ও ইউরোপের দেশগুলোর বিরুদ্ধে নিরাপত্তা নজরদারি কার্যক্রম চালায়। এমন কিছু লোক আছেন, যাঁরা ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। তারপর তাঁদের অন্য কোনো অঞ্চল বা এলাকায় ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের আরও অভিজ্ঞতা আছে। তাঁদের মানসিক অবস্থা আরও সহিংস। অনেক সময় প্রত্যাশিত ফল পেতে তাঁদের যথেষ্ট ধৈর্য থাকে না।’