কিস্তির টাকা জোগাড় হলেই ঘরে ফিরতে চেয়েছিলেন রনি, এখন দিশাহারা পরিবার

রনি প্রামাণিক | ছবি: সংগৃহীত

প্রতিনিধি বগুড়া: সেদিন সকালে কিছু না খেয়েই রিকশা নিয়ে বেরিয়েছিলেন রনি প্রামাণিক (২৮)। স্বামীর খোঁজ নিতে দুপুরে ফোন দেন স্ত্রী শামিমা খানম। রাস্তাঘাটের অবস্থা ভালো না হওয়ায় তিনি স্বামীকে অনুরোধ করেছিলেন তাড়াতাড়ি ঘরে আসতে। ফোনের ওপ্রান্ত থেকে জবাবে রনি বলেছিলেন, ‘কিস্তির টেকা এখনো জোগাড় হয়নি। টেনশন করিও না। রিকশাত খ্যাপ মারিচ্চি। কিস্তির টেকাটা জোগাড় হলেই চলে আসমো।’

গত ২০ জুলাই শেষ পর্যন্ত রনি আর ফেরেননি। পরে স্বজনেরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সময় বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন রনি প্রমাণিক। সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রাখা হয়েছে তাঁরা লাশ।

রনির বাড়ি বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঞ্জ ইউনিয়নের পঞ্চদাশ গ্রামে। স্ত্রী ও ছোট দুই সন্তান নিয়ে তিনি ভাড়া থাকতেন সাভারের ডেল্টার মোড় এলাকায়। ব্যাটরিচালিত অটোরিকশা চালিয়ে জোগাড় হতো সংসারের খরচ। স্বামীর সঙ্গে ফোনে শেষ কথা হওয়ার প্রসঙ্গ তুলে শামিমা খানম গতকাল শনিবার আহাজারি করতে করতে বলেন, ‘রনি, তুমিই হামাক ফোনত কইল্যা, ‘‘টেনশন করিও না’’, অথচ দুনিয়ার বুকত হামাক একা ফাইল্যা তুমি চলে গেলা। হামাক কেন তুমি সারাজীবনের জন্যি এতডা টেনশনে ফেলে দিয়্যা গেলা।’

রনির বাবা দিলবর রহমান প্রামাণিক অনেক আগেই মারা গেছেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে বড় রনি প্রমাণিক। তাঁর পাঁচ বছর এবং দেড় বছর বয়সী দুই ছেলে আছে। বড় ছেলের নাম ইয়াসির। ছোট ছেলের নাম ইভান। গুলিবিদ্ধ হয়ে রনি মারা যাওয়ার পর স্বজনদের মধ্যে চলছে শোকের মাতম।

ছেলেকে হারিয়ে শোকে স্তব্ধ হয়ে গেছেন শাহানা বেগম। গতকাল শনিবার বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার পঞ্চদাশ গ্রামে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

গতকাল শনিবার পঞ্চদাশ গ্রামে গিয়ে কথা হয় রনি প্রামাণিকের মা শাহানা বেগমের (৬৫) সঙ্গে। সংসারে একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে পাগলপ্রায় তিনি। শাহানা বেগম জানান, রনির বয়স যখন সাত বছর, তখন তাঁকে নিয়ে স্বামীর সঙ্গে সাভারে গিয়েছিলেন। রনিও অল্প বয়স থেকেই পোশাক কারখানায় কাজ শুরু করেছিল। বাবা-ছেলের সঙ্গে তিনিও গার্মেন্টসে কাজ করতেন। তিনজনের উপার্জনে মেয়ে শিল্পী খাতুনকে বিয়ে দেন। স্বামী মারা যাওয়ার পর তিনি গ্রামে ফিরে আসেন। থাকার জায়গাও নেই। খাসজমিতে ঘর তুলে কোনোরকমে থাকেন। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে রনি সাভারে থাকতেন। রিকশা চালিয়ে সংসার চালাতেন। মাসে মাসে তাঁকেও কিছু টাকা পাঠাতেন। ছেলের উপার্জনে চারজন মানুষের পেটে ভাত জুটত।

শাহানা আহাজারি করে বলেন, ‘হামার ব্যাটাডা কার ক্ষতি করিচিল? রিকশা চলাবার জন্যি বিয়ানবেলা না খ্যায়া ঘরত থ্যাকে বার হচে। বিকালবেলা গুলি খায়্যা লাশ হয়্যা বাড়িত ফিরল। ছলডাক ওরা পাখির মতো গুলি করে মারল!’

স্বজনেরা জানান, রনি যে পোশাক কারখানায় কাজ করতেন, সেখানেই কাজ করতেন শামিমা খানম। পরে ২০১৫ সালে তাঁদের পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। শামিমার বাবার বাড়ি গোপালগঞ্জের মকসুদপুর উপজেলার মজুমদা গ্রামে। তার বাবা আগেই মারা গেছেন। মা বিউটি বেগম ছাড়া পৃথিবীতে কেউ নেই।

শামিমা খানমের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর দুয়েক আগে বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণ নিয়ে সাভারে সবজির ব্যবসা শুরু করেছিলেন রনি। ভ্যানে করে মহল্লায় ঘুরে কাঁচা সবজি বিক্রি করতেন। সবজি ব্যবসায় লোকসানে দিশাহারা অবস্থা। ঘাড়ে চেপে বসে এনজিও থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি। সপ্তাহে দুই হাজার টাকা কিস্তি। মাসিক কিস্তিও শোধ দিতে হতো তিন হাজার। এর বাইরে ঘরভাড়া তিন হাজার। সব মিলিয়ে বেশ কিছুদিন চাপে ছিলেন রনি। এ কারণে প্রতিদিন সাতসকালে রিকশা নিয়ে বের হতেন। সারা দিন উপার্জন শেষে রাতে ঘরে ফিরতেন।

শামিমা খানম বলেন, ২০ জুলাই সকালেই রিকশা নিয়ে বের হন রনি। বেলা দেড়টার দিকে শেষ কথা হয় তাঁর সঙ্গে। কিস্তির টাকা জোগাড় হলেই ঘরে ফেরার কথা ছিল। বিকেল পাঁচটার দিকে হঠাৎ রনির মোবাইল থেকে কল আসে। ওপ্রান্ত থেকে কেউ একজন বলেন, রনি নেই। লাশ রাখা আছে এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি সেখানে গিয়ে গুলিবিদ্ধ লাশ দেখেন। বুকে গুলির চিহ্ন ছিল। রক্তে ভেজা গেঞ্জি। সেখানে যাওয়ার পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত লাশ নিয়ে চলে যেতে বলেন। প্রথমে ডেথ সার্টিফিকেট (মৃত্যুসনদ) দিতেও রাজি হয়নি। পরে একটা কাগজে লিখে দিয়েছে।

দিশাহারা হয়ে সাভারের ভাড়ার ঘর ছেড়ে দিয়েছেন শামিমা। আশ্রয় নিয়েছেন একট আত্মীয়র কাছে।

রনির ছোট বোন শিল্পী বেগম বলেন, ‘ভাইডা হামার কলিজার টুকরো আচলো। ঘরত বউ, দুডা ছোট ছোট ছল, বয়স্ক মা। হামার ভাইয়ের কামাইয়ে সগলির মুখত ভাত জুটত। এখন হামার ভাবির কী হবি? এতিম দুডা ছল কে দেখবি? হামার মাওক কে দেখবি?’

শিবগঞ্জ উপজেলার বুড়িগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রেজাউল করিম বলেন, রনি প্রমাণিক সাভারে রিকশা চালাতেন। তাঁর উপার্জনে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, দুই ছেলের মুখে ভাত জুটত। সহিংসতায় তাঁর মৃত্যুতে শ্রমজীবী পরিবারটি দিশাহারা ও অসহায় হয়ে পড়েছে। ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে পরিবারটির পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করা হবে।