আনোয়ার হোসেন: সড়ক ও রেল যোগাযোগ খাতের নয়টি প্রকল্পে চীনা ঋণের বিষয়ে আগ্রহী বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরে এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ইতিমধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতু এবং রেল মন্ত্রণালয় এসব প্রকল্পের তালিকা পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
সড়ক পরিবহন ও রেল মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, তালিকায় রেলের প্রকল্প রয়েছে ছয়টি। এর বাইরে ঢাকায় গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পথে মেট্রোরেলের একটি লাইন নির্মাণ, পিরোজপুরের কচা নদীর ওপর নতুন একটি সেতু নির্মাণ এবং মুন্সিগঞ্জের মুক্তারপুর সেতুর মেরামত প্রকল্প রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৮ থেকে ১১ জুলাই চীন সফর করতে পারেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ওই সফরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় রেল ও সড়ক যোগাযোগের প্রকল্পগুলোতে চীনা ঋণের বিষয়টি প্রাধান্য পেতে পারে।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, চীন থেকে কোন কোন প্রকল্পের জন্য ঋণ চাওয়া দরকার, সে বিষয়ে রেল মন্ত্রণালয়ের কাছে তালিকা চেয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি রেল মন্ত্রণালয় ছয়টি প্রকল্পের তালিকা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।
বাংলাদেশ ও চীন সরকারের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে জিটুজি–পদ্ধতিতে পদ্মা সেতুর দুই প্রান্তে ১৭২ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প শেষ পর্যায়ে। এই প্রকল্পের জন্য চীনের এক্সিম ব্যাংকের ঋণের মেয়াদ শেষ। আগামী নভেম্বর পর্যন্ত তা বাড়াতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। এ জন্য প্রকল্পটি চীনা ঋণের তালিকায় যুক্ত করা হয়েছে।
৩৯ হাজার ২৭৬ কোটি টাকায় বাস্তবায়নাধীন পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্পের মেয়াদ ছিল এ বছরের জুন মাস পর্যন্ত। এই প্রকল্পে চীনা ঋণের পরিমাণ ২৬৭ কোটি মার্কিন ডলার। ইতিমধ্যে ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙা পর্যন্ত নতুন রেলপথ দিয়ে ট্রেন চলাচল করছে। ভাঙা থেকে যশোর পর্যন্ত অংশে দুই-তিন মাসের মধ্যে রেল চালু হতে পারে বলে প্রকল্পসংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
রেলের আরও প্রকল্প
ফরিদপুরের ভাঙা থেকে বরিশাল হয়ে পায়রা বন্দর এবং কুয়াকাটা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণে অগ্রাধিকার রয়েছে সরকারের। এই রেলপথ নির্মিত হলে পদ্মা সেতু হয়ে সারা দেশের সঙ্গে পায়রা বন্দরের যোগাযোগ স্থাপিত হবে। নতুন করে দক্ষিণবঙ্গের চার জেলা বরিশাল, ঝালকাঠি, বরগুনা ও পটুয়াখালী রেল যোগাযোগের আওতায় আসবে।
রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, পদ্মা সেতু রেল সংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নকারী চীনের রাষ্ট্রীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না রেলওয়ে গ্রুপ (সিআরইসি) পায়রা পর্যন্ত রেললাইন সম্প্রসারণ প্রকল্প বাস্তবায়নে আগ্রহ দেখিয়ে আসছে। সম্প্রতি প্রকল্পের ধারণা নিতে বরিশালে গিয়েছিলেন বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। ভাঙা থেকে কুয়াকাটা পর্যন্ত নতুন রেলপথের প্রাক্-প্রকল্প প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পের সম্ভাব্য ব্যয় প্রায় ৪১ হাজার ৮০ কোটি টাকা।
চীনা ঋণে হলে এই প্রকল্প জিটুজি ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে চীন সরকার ওই দেশের একটিমাত্র ঠিকাদার নির্বাচন করে দেবে। এ পদ্ধতিতে ঠিকাদারের পক্ষে নানা শর্ত যুক্ত করা এবং পণ্যের মূল্য বেশি দেখানোর কারণে ব্যয় বাড়ে বলে সমালোচনা আছে।
চীনা ঋণ পেতে রেলের আরও যেসব প্রকল্পের তালিকা করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে জামালপুর পর্যন্ত মিশ্র গেজ রেলপথ নির্মাণ, পাবনার ঢালারচর থেকে ফরিদপুরের পাচুরিয়া পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণ, রাজবাড়ীতে একটি রেলওয়ে ওয়ার্কশপ নির্মাণ এবং ভৈরববাজার থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত মিটারগেজ লাইন মিশ্র গেজে রূপান্তর।
রেলমন্ত্রী জিল্লুল হাকিম গত রোববার বলেন, ভাঙা-কুয়াকাটা রেলপথ নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ আছে। এ প্রকল্পে চীনা ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অন্যান্য প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সব প্রকল্পের অর্থায়ন তো এক জায়গা থেকে হয় না। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তর আলাপ-আলোচনা করে বাংলাদেশের জন্য সুবিধাজনক হয় এমন উৎস থেকে অর্থায়নের ব্যবস্থা করবে।’
সড়ক যোগাযোগের প্রকল্প
সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন ২০৩০ সালের মধ্যে ঢাকায় মেট্রোরেলের ছয়টি লাইন নির্মাণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হয়েছে। গাবতলী থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত মেট্রোরেল লাইন-২–এর ঋণ এখনো নিশ্চিত হয়নি। এ প্রকল্পের জন্য চীনা ঋণ পেতে আগ্রহী সড়ক মন্ত্রণালয়। এ নিয়ে সরকারের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
সেতু বিভাগের অধীন পিরোজপুরে কচা নদীর ওপর আরেকটি চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু নির্মাণে চীনা ঋণ পেতে চেষ্টা চালাচ্ছে সরকার। পিরোজপুর ও ঝালকাঠির মধ্যে কচা নদীতে এরই মধ্যে একটি সেতু চালু হয়েছে। নতুন সেতুটি ভান্ডারিয়া ও ইন্দুরকানির মধ্যে চরখালী ফেরিপথে নির্মাণ করা হবে। দেড় কিলোমিটারের কিছু বেশি দীর্ঘ হবে সেতুটি। আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার মতো। এ ছাড়া মুন্সীগঞ্জের মুক্তারপুর সেতুর মেরামত দরকার। এটি চীনা ঋণে নির্মাণ করা হয়েছিল। এখন মেরামতেও চীনের সহায়তা চাইছে সরকার।
সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন বলেন, তাঁরা কিছু প্রকল্পের প্রস্তাব করেছেন। তবে কোনটার অর্থায়ন কোথা থেকে হবে, তা সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে ঠিক করা হবে।
২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের বাংলাদেশ সফরের সময় বেশ কিছু চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়। এরপর থেকে চীন বাংলাদেশের যোগাযোগ অবকাঠামো, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ঋণ দেওয়া বাড়িয়ে দেয়। প্রায় এক দশক পর আগামী সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরে বাংলাদেশের জন্য চীনের ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ প্রায় ৫ হাজার ৪০ কোটি ইউয়ানের বেশি ঋণ দেওয়ার সম্ভাবনা আছে বলে পররাষ্ট্র ও ইআরডি সূত্রে জানা গেছে।
বড় প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ ফাওজুল কবীর খান বলেন, অর্থনীতি এমনিতেই সংকটে আছে। বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ আছে। ঋণ নিয়ে প্রকল্প করলে কী লাভ হবে, টাকা ফেরত দেওয়া যাবে কি না, এগুলো ভাবা দরকার। তিনি বলেন, চীনা ঋণে করা প্রকল্পের অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এগুলো চীনের ঠিকাদার ও তাদের বাংলাদেশি এজেন্টকেন্দ্রিক। প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ঠিকাদার নিয়োগ হয় না। এ জন্য ব্যয় ১৫ থেকে ২৫ শতাংশ বেশি হয়।