নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবরোধ কর্মসূচি ‘বাংলা ব্লকেডে’র কারণে গতকাল স্থবির হয়ে পড়ে রাজধানী শহর। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ ও বিক্ষোভ করেছেন শিক্ষার্থীরা। আজ সোমবারও শিক্ষার্থীদের এ কর্মসূচি চলবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববারের বাংলা ব্লকেডে কার্যত অচল হয়ে পড়ে ঢাকার বড় অংশ। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর ব্যানারে শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা ঘোষণা দেন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে অনির্দিষ্টকালের জন্য তাঁরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করে ছাত্র ধর্মঘট কর্মসূচি অব্যাহত রাখবেন।
ছাত্র ধর্মঘটের পাশাপাশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়কে অবরোধ কর্মসূচি চলবে। আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম এই কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে বলেন, ‘আজ (রোববার) আমরা শাহবাগ থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত গিয়েছি। কাল ফার্মগেট পার হয়ে যাব।’ আজ বেলা সাড়ে তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে শিক্ষার্থীদের জমায়েত হবে জানিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, ‘কোনো আবাসিক হলে বাধা দেওয়া হলে আমাদের জানাবেন। আমরা সম্মিলিতভাবে সেই হল ঘেরাও করব।’
পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী গতকাল শুধু ঢাকাতেই আটটি স্থানে সড়ক অবরোধ করেন বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা। কেন্দ্রীয়ভাবে শাহবাগ মোড় অবরোধ করা হয়। এখান থেকে শিক্ষার্থীদের একটি অংশ গিয়ে পাশের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড় দখল করে কারওয়ান বাজারের কাছাকাছি আসে। এ ছাড়া সায়েন্স ল্যাবরেটরি, নিউমার্কেট, নীলক্ষেত, চানখাঁরপুল ও আগারগাঁওয়েও সড়ক অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির অংশ হিসেবে বেলা আড়াইটার পর শিক্ষার্থীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে জড়ো হতে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল ও বিভাগের ব্যানারে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে শিক্ষার্থীরা আসতে থাকেন। বেলা সোয়া তিনটার মধ্যে গ্রন্থাগারের সামনে দুই সহস্রাধিক শিক্ষার্থী জড়ো হন। বেলা সাড়ে তিনটার দিকে শুরু হয় মিছিল-স্লোগান। পরে বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বিকেল চারটার দিকে শাহবাগ মোড় অবরোধ করেন কয়েক হাজার শিক্ষার্থী। এ সময় শাহবাগ মোড় দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ হয়ে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। একে একে বিভিন্ন এলাকায় অবরোধের ফলে রাজধানীর বড় অংশ তীব্র যানজটের কবলে পড়ে।
বিভিন্ন সড়ক অবরোধ
কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা ঢাকার সায়েন্স ল্যাব এলাকা অবরোধ করেছেন। গতকাল রোববার দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
শিক্ষার্থীরা ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘একাত্তরের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’ প্রভৃতি স্লোগান দেন। ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়ে বিকেল পাঁচটার দিকে বিদেশি অতিথিবাহী মাইক্রোবাস আটকে দেন শিক্ষার্থীরা। ‘গো ব্যাক, গো ব্যাক’ স্লোগানে গাড়িটি পিছু হটে।
একদল আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী বিকেলে রাজধানীর চানখাঁরপুল মোড় অবরোধ করেন। এতে ওই সড়ক দিয়েও যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। এর প্রভাব পড়ে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপরও। সেখানেও তীব্র যানজট তৈরি হয়। বেলা পৌনে দুইটা থেকে রাজধানীতে যান চলাচলের আরেক গুরুত্বপূর্ণ এলাকা সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজের আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা। তবে দুপুর ১২টা থেকেই তাঁরা সেখানে জড়ো হতে থাকেন। সন্ধ্যা সাতটার দিকে অবরোধ তুলে নিয়ে তাঁরা কলেজে ফিরে যান। ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রীরা রাজধানীর নীলক্ষেত মোড় অবরোধ করেন। আগারগাঁওয়ে সড়ক অবরোধ করেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা।
কোটাব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে সরকারের জারি করা পরিপত্র পুনর্বহালসহ চার দফা দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীরা সোয়া চার ঘণ্টা পর রাজধানীর শাহবাগ মোড় ছাড়েন। রাত আটটার দিকে অবরোধ তুলে নেন তাঁরা। তখন যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। প্রতিটি অবরোধের স্থানেই পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন ছিল।
শাহবাগ মোড়ের অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেন আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। বক্তব্য দেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা সারজিস আলম ও হাসনাত আবদুল্লাহ। সন্ধ্যার দিকে এই তিন নেতাসহ আরেক নেতা আসিফ মাহমুদকে পুলিশ ডেকে নিয়ে কথা বলে। ফিরে এসে তাঁরা সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা কোনো আপসে যাবেন না।
নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন বিদ্যুৎগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। শিক্ষার্থীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজপথে নেমে কর্মসূচি পালন করেছেন। আমাদের আদালত দেখিয়ে লাভ নেই, আমরা আপনাদের সংবিধান দেখাচ্ছি। আমরা আশা করি, প্রধানমন্ত্রী এবারও শিক্ষার্থীদের মতের পক্ষে সংসদে দাঁড়িয়ে কোটার বিষয়ে চূড়ান্ত সুরাহা দেবেন।’
শিক্ষার্থীদের দাবি
সরকারি চাকরিতে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা রোববার শাহবাগসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি এলাকায় সড়ক অবরোধ করায় তীব্র যানজট তৈরি হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কারওয়ানবাজার এলাকার চিত্র | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল বেলা ১১টা ১০ মিনিট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে অবরোধ শুরু করেন। এ সময় সড়কের দুই পাশে যানজটের সৃষ্টি হয়। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে একটি বিক্ষোভ মিছিল বের করেন আন্দোলনকারীরা। মিছিলটি কয়েকটি সড়ক ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে গিয়ে শেষ হয়।
চার দফা দাবিতে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেল চারটায় নগরের ষোলশহর রেলস্টেশন থেকে মিছিলের মধ্য দিয়ে কর্মসূচির শুরু হয়। তবে পুলিশের বাধার মুখে মিছিলের গন্তব্য পরিবর্তন করেন শিক্ষার্থীরা।
নগরের বহদ্দারহাটের উড়ালসড়কের র্যাম্প অভিমুখে মিছিল নিয়ে রওনা হন শিক্ষার্থীরা। তবে স্টেশন এলাকার মূল ফটকে আসতেই পুলিশের বাধার মুখে পড়েন তাঁরা। এ সময় পুলিশের কয়েকজন সদস্য শিক্ষার্থীদের বাধা দিয়ে গন্তব্য সম্পর্কে জানতে চান। পরে শিক্ষার্থীরা তাঁদের গন্তব্য নগরের মুরাদপুর হয়ে বহদ্দারহাটের উড়ালসড়কের সামনে পর্যন্ত জানালে পুলিশ তাঁদের আটকে দেয়। এ সময় শিক্ষার্থীরা পুলিশের উদ্দেশে ‘ভুয়া’ স্লোগান দেন। কিছুক্ষণ পুলিশের সঙ্গে তর্কাতর্কির পর শিক্ষার্থীরা মিছিল নিয়ে ২ নম্বর গেট এলাকায় আসেন। শিক্ষার্থীরা সেখানে কোটাবিরোধী বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড নিয়ে অবস্থান করেন। প্রায় এক ঘণ্টা অবস্থান নিয়ে তাঁরা কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। এ সময় সড়কে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
কোটাপদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে পথনাটক, কবিতা, গান পরিবেশন করে ব্যতিক্রমী সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ জানিয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কার্যক্রম ও বাস চলাচল বন্ধের ঘোষণা দেন আন্দোলনকারীরা। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন রেললাইন অবরোধ করা হবে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
বেলা ১১টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্যুঞ্জয়ী মুজিব ম্যুরালের সামনে প্ল্যাকার্ড, ব্যানার ও ফেস্টুন এবং জাতীয় পতাকা নিয়ে জড়ো হন শতাধিক শিক্ষার্থী। পরে তাঁরা মিছিল নিয়ে ক্যাম্পাস প্রদক্ষিণ করে প্রধান ফটক হয়ে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। অবরোধ চলাকালে সড়কে গাছের গুঁড়ি ফেলে ও খড়কুটায় আগুন জ্বালিয়ে যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। দুই ঘণ্টা অবরোধ শেষে বেলা দেড়টার পর শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ভেতর চলে যান।
বেলা ১১টায় শিক্ষার্থীরা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে জড়ো হয়ে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ মিছিল করেন। বৃষ্টির মধ্যে দুপুর ১২টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকের সামনে ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে মহাসড়কের গড়িয়ার পাড় থেকে রূপাতলী পর্যন্ত তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। একই দাবিতে বরিশাল ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের শিক্ষার্থীরাও বেলা ১১টা থেকে বরিশালের নথুল্লাবাদ এলাকায় মহাসড়ক অবরোধ করেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়
বিকেল চারটায় কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এসে চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ি অংশে অবস্থান নেন। ৪৫ মিনিট ধরে অবরোধের ফলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ি থেকে দুই দিকে অন্তত ১৫ কিলোমিটারে যানজট সৃষ্টি হয়।
হাজী দানেশ বিশ্ববিদ্যালয়
সকাল ১০টা থেকে দিনাজপুরের হাজী মুহ্ম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের প্রধান ফটকে জড়ো হতে থাকেন। পরে বেলা ১১টায় দিনাজপুর-রংপুর মহাসড়ক অবরোধ করেন। পুলিশ ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা তাঁদের অবরোধ প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। আধা ঘণ্টা পর শিক্ষার্থীরা সড়ক থেকে সরে যান। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে কয়েকটি সড়কে তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল করেন।
বিকেল পাঁচটা থেকে সন্ধ্যা পৌনে সাতটা পর্যন্ত ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার পাথালিয়ায় অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় মহাসড়কের দুই পাশে যানবাহন আটকা পড়ে।