পদ্মা ট্রিবিউন গ্রাফিক্স |
প্রতিনিধি ঈশ্বরদী: পাবনার ঈশ্বরদী ৭ ইউনিয়ন ও এক পৌরসভা নিয়ে গঠিত। বর্তমানে মাদকের ভয়াবহ ছোবলে জর্জরিত উপজেলায় বারো মাসই ঘটা করেই অভিযান চালায় পুলিশ, র্যাব ও মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর। থানা পুলিশের সদস্যরাও বিভিন্ন এলাকার সড়কে চৌকি ফেলে তল্লাশি করছে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে ঈশ্বরদীতে মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার হয়েছে। কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতিটা ঠিক তার উল্টো।
উপজেলার তিনটি গ্রাম মাদক ব্যবসার প্রধান ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। নৌ ও রেলপথে আনা বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য উপজেলার পাকশী, মাঝদিয়া ও সাঁড়া গ্রামে মজুত রাখার পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয়। এ ছাড়া উপজেলার ২০টি স্থানে ফেনসিডিল, হেরোইন, গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদকদ্রব্য অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে।
মাদক ব্যবসায়ী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বিভিন্ন স্থানে প্রতিদিন গড়ে লাখ-লাখ টাকার ফেনসিডিল বিক্রি হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মাদক ব্যবসায়ী জানান, বর্তমানে এই উপজেলায় প্রায় এক হাজার মাদক ব্যবসায়ী আছেন। ফেনসিডিল ছাড়াই প্রতিদিন উপজেলার বিভিন্ন স্থানে হেরোইন, গাঁজা, মদ, তাড়িসহ লাখ-লাখ টাকার মাদকদ্রব্য বিক্রি হয়।
মাঝদিয়া গ্রামের এক শিক্ষক জানান, এই গ্রামে শতাধিক মাদক ব্যবসায়ী আছেন। তাঁরা প্রভাবশালী এবং সন্ত্রাসী। মাইক্রোবাস, মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়িতে (প্রাইভেট কার) করে প্রতিদিন প্রচুর ফেনসিডিলের বোতল ঢাকায় পাঠানো হয়। উপজেলার ফতেহমোহাম্মদপুর, পশ্চিম টেংরী কাচারীপাড়া (ব্লাকপাড়া), আমবাগান, কলেজ রোড, গোকুলনগর, আড়মবাড়িয়া, পাকশী, দাশুড়িয়াসহ ২০টি স্থানে ফেনসিডিল বিক্রি করা হয়।
প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, প্রতিদিন পাবনা সদর, আটঘরিয়া; কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা ও নাটোরের লালপুর থেকে অনেক তরুণ ব্যক্তিগত গাড়ি, মাইক্রোবাস ও মোটরসাইকেল নিয়ে ঈশ্বরদীর এসব স্থানে এসে ফেনসিডিল সেবন করেন।
মাদক ব্যবসায়ীরা জানান, নাটোরের বিলমারিয়া, দুরদুরিয়া, নবীনগর, সাঁড়া ইউনিয়নের ৫ নম্বর ঘাট ও লালপুর নদীর ঘাট; রাজশাহীর বাঘা উপজেলার চারঘাটসহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলার ভারতীয় সীমান্ত এলাকা দিয়ে নৌপথে এসব ফেনসিডিলের বোতল ঈশ্বরদীতে আনা হয়। রেলপথে দিনাজপুরের হিলি, হাকিমপুর; রাজশাহীর পবা, আড়ানি, লোকমানপুর, আবদুলপুর স্টেশন দিয়ে এই উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ফেনসিডিল আনা হয়। এ ছাড়া কুষ্টিয়ার বিভিন্ন উপজেলার ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে পাচার হয়ে আসা ফেনসিডিলের বোতল নৌপথে এনে প্রথমে সাঁড়ার ৫ নম্বর নৌঘাটে মজুত করা হয়। এরপর চানমারী গ্রামে নিয়ে এগুলো বস্তা ও পলিথিনের মধ্যে রাখা হয়। শেষে এগুলো রেলপথে ঢাকা, গাজীপুর, সিরাজগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হয়।
নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক মাদকসেবী বলেন, এখন একটা ফেনসিডিলের দাম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। তাই সবাই খেতে পারে না। বাইরে থেকে লোকজন আসে তারা খেতে দেয়। তাছাড়া একটা বিক্রি করতে পারলে চার থেকে পাঁচশত টাকা লাভ হয়। এই টাকার ভাগ স্থানীয় অনেকেই পায়। কথা বলার এক পর্যায়ে বলে ওঠে তা না হলে সারাদিন বাজারে ঘোরে ব্যবসা নেই, চাকরি নেই, বেনসন সিগারেট খায় দামি বাইক চালায় টাকা আসে কোথা থেকে।
স্থানীয়রা জানায়, বিকাল ৩টা থেকে ৬টা পর্যন্ত লোকজন আসতে থাকে। দামী মোটরসাইকেল নিয়ে আসে। একেকবারে ৪-৫ জন করে আসে, সাথে এই এলাকার ছেলেরাও আসে এবং সাঁড়া ইউনিয়নের পদ্মা নদীর পাড়ে চলে যায়। এক প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, আমরা চিনি কিন্তু নাম বলতে পারবো না। আগে একবার পুলিশে কয়েকজনকে ধরে ছিলো। সেইজন্য আমাদেরকে দোষ দিয়েছে, যে আমরা তাকে ধরিয়ে দিয়েছি।
৮ জুলাই সোমবার পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তত ১০-১২ জন বাসিন্দার সঙ্গে কথা হয়েছে এ প্রতিবেদকের। এলাকার সমস্যা কী—জানতে চাইলে তাঁদের একটাই জবাব, এলাকায় মাদক ছেয়ে গেছে। এ এলাকায় মাদকের সমস্যা নতুন নয়। আগে মাদক ছিল পশ্চিম টেংরী কাচারীপাড়া কেন্দ্রিক। বর্তমানে তা এই এলাকার পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েছে।
ঈশ্বরদী সরকারি সাঁড়া মাড়োয়ারী মডেল স্কুল এন্ড কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আয়নুল ইসলাম জানান, ঈশ্বরদী মাদকে ছেয়ে গেছে। সন্ধ্যার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মাদকসেবীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। মাদকের অর্থ জোগাড় করতে এরা অনেক সময় চুরি বা ছিনতাইয়ের মতো কাজও করছে। অনেকে প্রকাশ্যেই মাদক গ্রহণ করছে এবং বিক্রি করছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের যুবসমাজ ধ্বংস হতে বেশি সময় লাগবে না। মাদকের এত ছড়াছড়ি থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কার্যকর ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। প্রশাসন কার্যকর উদ্যোগ নেবে কি?
পাকশী রেলওয়ে ডিগ্রি কলেজের প্রাক্তন অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেন, ঈশ্বরদীর মতো মাদকের এত ভয়াবহতা কোথাও দেখেননি। এখানে পারিবারিকভাবে মাদক ব্যবসা করা হয়। রেলের কোয়ার্টারগুলো মাদক ব্যবসার প্রধান ঘাঁটি। পুলিশ অভিযান চালায়। ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করে। আবার তারা জামিন নিয়ে এসে ব্যবসা শুরু করে। প্রবল সামাজিক আন্দোলন না হলে এখানে মাদকের ভয়াবহতা রোধ করা কঠিন বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধু পরিষদ ঈশ্বরদী উপজেলা কমিটির আহবায়ক অধ্যাপক উদয় নাথ লাহেড়ী বলেন, ইয়াবা, ফেনসিডিল, গাঁজা, হেরোইন প্রভৃতি রকমারি মাদকে ছেয়ে গেছে এখানকার অলিগলি। এসব মাদকদ্রব্যের বেশির ভাগ ক্রেতাই হচ্ছে বেকার যুবক। এখানে গাঁজা বা মদ এখন অনেকটা ভাত-মাছের মতো সহজলভ্য হয়ে গেছে। ছোট থেকে শুরু করে যুবকদের মধ্যে বেশির ভাগ ছেলেই মাদক গ্রহণ করছে। এরা অল্প বয়সেই পথে বসে যাচ্ছে।
পুলিশের ঈশ্বরদী সার্কেল কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ১ মার্চ মাস থেকে ১৮ জুন পর্যন্ত পুলিশ বিশেষ অভিযান চালিয়ে প্রায় ৪৯ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করেছে। এসব ঘটনায় ঈশ্বরদী থানায় একাধিক মামলা হয়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঈশ্বরদী সার্কেলের পরিদর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, যত দিন মাদক থাকবে তত দিন অভিযান চলবে। এখন পর্যন্ত তাঁরা সফল। যতগুলো অভিযান পরিচালিত হয়েছে, সে তুলনায় অর্জন ভালো।
তারপরও হাত বাড়ালে মাদক পাওয়া যায় কেন? এর জবাবে আল মামুন বলেন, এটা ৯০ মিনিটের খেলা নয়। চাহিদা থাকলে জোগান আসে। আর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করা অনেকগুলো বাহিনীর একটি।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. রফিকুল ইসলাম জানান, বর্তমানে ঈশ্বরদীতে মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তবে কিছু মাদক ব্যবসায়ী ভ্রাম্যমাণ অবস্থায় মাদক বিক্রি করছেন।
ঈশ্বরদী সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার গোস্বামী জানান, মাদকের বিরুদ্ধে আমরা জিরো টলারেন্স। আমরা মনে করি মাদকসেবী বেশি থাকার কারণে এখানে মাদকের চাহিদাও বেশি। মাদক কীভাবে বন্ধ করা যায় সেটা নিয়ে নিয়মিত কাজ করছি। গত কয়েকদিনে বেশ কিছু অভিযানে মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। আগামীতেও তা অব্যাহত থাকবে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এমদাদুল হক রানা সরদার বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে প্রচার-প্রচারণার জন্য উপজেলা পর্যায়ে যেসব কমিটি আছে সেগুলোকে আমরা সক্রিয় করছি। এছাড়া বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কমিটি গঠন করেছি। সেগুলোকেও সক্রিয় করার চেষ্টা চলছে। যাতে তাদের মাধ্যমে আমরা মাদকের বিরুদ্ধে একটি সামাজিক আন্দোলন শুরু করতে পারি।
এদিকে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভায় পাবনা-৪ আসনের সংসদ গালিবুর রহমান শরীফ এমপি মাদক সেবন ও বিস্তারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি প্রশ্ন রেখে বলেন, মাদক সেবন কেন বাড়ছে, কেন মাদক বিস্তাররোধ করা যাচ্ছে না? তিনি বলেন, শুধু সেবনকারীদের ধরলে হবে না, ডিলার ও ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করতে হবে। সমাজ থেকে এদের নির্মুল না করলে, মাদক সেবন, বিস্তার কমবে না।