শুভ্র দেব: শনিবার রাত ১১টা। রাজধানীর মগবাজার ডাক্তারগলি এলাকা। অন্যান্য রাতের মতোই গলির বাসিন্দা ও ব্যবসায়ীরা স্বাভাবিক কাজকর্ম করছিলেন। হঠাৎ করে পুলিশের কয়েকটি গাড়ি যখন ওই গলিতে প্রবেশ করে তখনই বদলে যায় স্বাভাবিক চিত্র। একে একে গাড়ি থেকে নামেন অন্তত ৪০ জনের মতো পুলিশ সদস্য। তাদের মধ্যে বিভিন্ন পদমর্যাদার কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবলরা ছিলেন। পুলিশের সদস্যরা গলির প্রত্যেকটি প্রবেশ পথে অবস্থান নেন যাতে করে কেউ গলি থেকে বের হতে না পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্লক রেইড নামের অভিযানটি প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী স্থায়ী ছিল। এ সময়টা পুরো এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করে। ভয়ে গলির অনেক ব্যবসায়ী দোকান বন্ধ করে বাসায় চলে যান।
স্থানীয় ব্যবসায়ী নান্নু খান বলেন, আমারসহ অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খোলাই ছিল।
গলিতে পুলিশের গাড়িগুলো প্রবেশ করে প্রথমেই গলির মুখের একটি বাসার দারোয়ানের কাছে খোঁজখবর নিয়ে ভেতরের একটি গলির দিকে চলে যায়। পরে তারা ডাক্তারগলির বিভিন্ন বাসায় অভিযান চালায়। গাউসিয়া মঞ্জিলের এক কেয়ারটেকার বলেন, আশেপাশের সবক’টি বাসায় পুলিশের সদস্যরা অভিযান চালিয়েছে। আমাদের বাসা থেকে মনর উদ্দিন নামের একজন আইনজীবীকে নিয়ে গেছে। এ ছাড়া আমাদের পাশের বাসা থেকে শুনেছি কয়েকজন শিক্ষার্থীকে আটক করা হয়েছে। ওই এলাকায় বসবাসরত এক গণমাধ্যম কর্মী বলেন, রাস্তায় যাকে পেয়েছে পুলিশ সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। আইডি কার্ড, পেশার খোঁজখবর নিয়েছে। যারা আইডি কার্ড দেখাতে পেরেছে তাদের ছেড়ে দিয়েছে।
শনিবার রাতে বিজিবি’র সহযোগিতায় পুলিশ আজিমপুর কোয়ার্টার এলাকায় ব্লকরেইড দিয়েছে। শুরুতেই ওই এলাকার প্রত্যেকটি প্রবেশ ও বের হওয়ার রাস্তা ঘিরে ফেলে তারা। তারপর একে একে বিভিন্ন বাসা বাড়িতে গিয়ে অভিযান চালায়। সংঘাত সহিংসতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না এমন সাধারণ মানুষরাও ভয়ের মধ্যে ছিলেন। এলাকাবাসী বলেন, শনিবার রাতের ব্লকরেইডে অনেককে আটক করা হয়েছে। শামসুল আলম নামের এক বাসিন্দা বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেক গাড়ি এলাকায় যখন প্রবেশ করে তখন সবাই ভয়ে বাসার ভেতরে অবস্থান করে। বাইরে যারা ছিল তাদের কড়া জেরার মধ্যে পড়তে হয়েছে। অনেককে হেনস্তা করা হয়েছে। তারপর তারা অনেক বাসায় গিয়ে অভিযান চালায়।
বৃহস্পতিবার রাত ১১টায় রাজধানীর শাহীনবাগ এলাকায় রুদ্ধশ্বাস এক ব্লকরেইড দেয় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ওইদিন রাত ১১টার দিকে এলাকাটিতে হঠাৎ করে হেলিকপ্টার টহল দিচ্ছে এমনটি দেখতে পান বাসিন্দারা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা এলাকার বিভিন্ন অলিগলির প্রবেশমুখসহ বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন। মাইকিং করে বলা হয় এলাকাটিতে অভিযান চালানো হবে। এর পরপরই সেখান সড়ক বাতি বন্ধ করে দেয়া হয়। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা সেখানকার বাসা বাড়িতে গিয়ে নক দিয়ে আন্দোলনকারী খুঁজতে থাকেন। কয়েক ঘণ্টাব্যাপী অভিযানে অনেককে আটক করা হয়।
চলমান কোটা আন্দোলতে সংঘাত, নাশকতা ও সহিংসতা ঘিরে ব্লকরেইড দিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আর এই ব্লকরেইড এখন এক আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে। কারণ যেদিন যে এলাকায় ব্লকরেইড দেয়া হয় সেদিন ওই এলাকায় ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক কাজ করে। অভিযোগ আছে, অভিযানে থাকা পুলিশ ও গোয়েন্দা সদস্যরা অনেক সময় আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেন না। এমনিতেই যখন পুলিশ কারও বাসায় প্রবেশ করে তখন আতঙ্কে অনেকে ঠিকমতো কথা বলতে পারেন না। তার ওপর জিজ্ঞাসাবাদে একটু হেরফের হলেই আটক করা হচ্ছে। সরকারবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে জড়িত, বিএনপি, ছাত্রদল, যুবদল, জামায়াত, শিবিরের নেতাকর্মীরা আতঙ্কে বাড়িছাড়া।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সূত্র জানিয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় ডিএমপির বিভিন্ন থানায় আরও ২৪টি মামলা হয়েছে। আগের ২০৭ মামলাসহ এ নিয়ে মোট মামলার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২২৯টিতে। অন্যদিকে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে আরও ২২৮ জন ও আগের ২৫৩৬ নিয়ে মোট গ্রেপ্তারের সংখ্যা ২৭৬৪ জন। ডিএমপির পদস্থ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ব্লকরেইড অব্যাহত আছে। প্রতি রাতেই গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন এলাকা চিহ্নিত করে রেইড দেয়া হচ্ছে। তবে যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে তাদেরকেই প্রথমে আটক করা হয়। যাচাই বাছাই করে পরে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়। র্যাব সদর দপ্তরের আইন ও গণমাধ্যম শাখা থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, দেশ জুড়ে সাম্প্রতিক নাশকতার ঘটনায় ঢাকায় ৭৭ জন ও ঢাকার বাইরে ২২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ নিয়ে র্যাবের হাতে আটক হয়েছেন সর্বমোট ৩০৪ জন। র্যাবের পদস্থ কর্মকর্তারা বলেছেন, চলমান সহিংসতা, নাশকতা ও অগ্নিসংযোগের সঙ্গে যারাই জড়িত তাদেরকে আইনের আওতায় আনতে দেশব্যাপী র্যাবের সব ব্যাটালিয়ন কাজ করছে।
পুলিশ সদর দপ্তর ও প্রতিনিধির তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত সারা দেশে সাড়ে ৬ শতাধিক মামলা হয়েছে। এসব মামলায় প্রায় ১১ হাজার বিরোধী ঘরানার রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিছু কিছু মহানগর, জেলা ও থানা এলাকায় পুরাতন মামলায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তারের সংখ্যার হিসাবে সবচেয়ে বেশি গ্রেপ্তার করেছে ডিএমপির বিভিন্ন থানা ও গোয়েন্দা বিভাগ। ডিএমপি ছাড়াও ঢাকা রেঞ্জ পুলিশের ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, মুন্সীগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, রাজবাড়ী, মাদারীপুর, গোপালগঞ্জ, শরীয়তপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল জেলা পুলিশ। চট্টগ্রাম মট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি), চট্টগ্রাম রেঞ্জ পুলিশের চট্টগ্রাম ফেনী, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজার, কুমিল্লা, বাহ্মণবাড়িয়া, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলা পুলিশ। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি), সিলেট রেঞ্জ পুলিশের সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ। খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের (কেএমপি), খুলনা রেঞ্জ পুলিশের খুলনা, চুয়াডাঙ্গা, ঝিনাইদহ, মাগুরা, বাগেরহাট, মেহেরপুর, সাতক্ষীরা, নড়াইল, যশোর ও কুষ্টিয়া জেলা পুলিশ। বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ (বিএমপি), বরিশাল রেঞ্জ পুলিশের বরিশাল, ভোলা, পিরোজপুর, পটুয়াখালী, বরগুনা জেলা পুলিশ। ময়মনসিংহ রেঞ্জ পুলিশের ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, শেরপুর ও জামালপুর জেলা পুলিশ। রংপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি), রংপুর রেঞ্জ পুলিশের রংপুর, পঞ্চগড়, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম ও ঠাকুরগাঁও জেলা পুলিশ। রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশের (আরএমপি), রাজশাহী রেঞ্জ পুলিশের রাজশাহী, নওগাঁ, জয়পুরহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলা পুলিশ গ্রেপ্তার অভিযান পরিচালনা করছে। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, এখন পর্যন্ত তাদের ৯ হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এদিকে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশ অযথাই সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। রাস্তায় বা বাসায় অবস্থানের সময় যাদের মোবাইলে কোটা আন্দোলনের ছবি ও ভিডিও পাওয়া যাচ্ছে তাদেরকেও আটক করা হচ্ছে। এ ছাড়া এলাকাভিত্তিক যাদের সঙ্গে শত্রুতা রয়েছে তাদেরকে জামায়াত-শিবির হিসাবে পরিচয় দিয়ে গ্রেপ্তার করানো হচ্ছে। এক্ষেত্রে অনেক নিরীহ ও সাধারণ মানুষও বিপদে পড়ে যাচ্ছেন।
ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপারেশন) বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, সহিংসতার ছবি ও ভিডিও দেখে শনাক্ত করে পরে অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। অযথা কাউকে হয়রানি করা হয় না। ব্লকরেইডের স্থায়িত্ব নিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের প্রয়োজন অনুযায়ী রেইড দিচ্ছি। যে এলাকায় আসামি ধরা প্রয়োজন সেই এলাকাতে দিচ্ছি। প্রয়োজন না হলে রেইড দিচ্ছি না।