বগুড়া শহরের সাতমাথা এলাকায় সড়কের পাশে বসে লটকন ও ড্রাগন ফল বিক্রি করছেন এক ব্যক্তি। গতকাল তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি বগুড়া: বগুড়া শহরের কলোনি বাজার। প্রতিদিন ভোরে এ বাজারেই শ্রম কেনাবেচার হাট বসে। দিনমজুরেরা দৈনিক মজুরিতে শ্রম বিক্রির জন্য ডালি-কোদাল, করণী-পাটা হাতে প্রতিদিন ভোরে এই হাটে দাঁড়িয়ে থাকেন। লোকজন দরদাম করে দিনচুক্তিতে শ্রমজীবীদের কাজে নিয়ে যান। দিন শেষে কাজের ধরন অনুযায়ী শ্রমজীবীরা ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা মজুরি পান। গতকাল মঙ্গলবার কারফিউ উপেক্ষা করে এই হাটে করণী-পাটা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন রাজমিস্ত্রি আফসার আলী (৫৫)। তিনি এসেছেন ২৫ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার পাকুল্যা গ্রাম থেকে।

তখন সকাল ১০টা। শ্রমের হাট ক্রেতাশূন্য। ঠা ঠা রোদে দাঁড়িয়ে থাকা আফসার আলীর শরীর থেকে তখন ফোঁটা ফোঁটা ঘাম ঝরছে। বললেন, ‘ছয়জনের সংসারত চাল-ডাল, তরিতরকারি কিনতে লিত্তিদিন (প্রতিদিন) ৬০০ টেকা খরচ লাগে। ঘর করবার য্যায়া এনজিওত থ্যাকে এক লাখ টেকা লোন করিচি। সপ্তাহের শ্যাষ দিন আছে লোনের কিস্তির চাপ। চার দিন ধরে দ্যাশত কারফিউ চলিচ্চে। বগুড়াত গন্ডগোল তারও তিন দিন আগে থ্যাকে। কাজকাম বন্ধ। প্যাট তো আর বন্ধ রাখপার পারিচ্চি না। ঘরত যা মিচ্চি অ্যানা চাল আচলো, এই কয়ডা দিন একবার রান্না করে তিন বেলা খাচি। এখন ঘরত চাল-ডাল সবই শ্যাষ।

কারফিউ ভাঙে বিয়ানবেলা বাড়িত থ্যাকে কাজের খোঁজে শহরত আচ্চি। কিন্তু কাম নাই, কামাইও নাই। রাত থ্যাকে প্যাটত কিছুই পড়েনি, না খায়্যা আচি। বাড়িত ফেরার পথখরচের টেকাটাও পকেটত নাই। খালি হাতে বাড়িত ফিরে যামু ক্যামনে? অনাহারী ছলগুলোর (সন্তান) মুখোত দিমো কী? অভাবে অচল সংসার। হামাকেরে মতো গরিবের সংসারত এখন ঘরে-বাইরে দুই জায়গাতেই কারফিউ চলিচ্চে।’

চার দিন ধরে কারফিউয়ের কারণে শহরে ভবন নির্মাণকাজ বন্ধ। আফসার আলীর মতো রাজমিস্ত্রিদেরও তাই কামাই-রোজগার বন্ধ। তাঁর মতো শ খানেক শ্রমিক এদিন সকাল থেকে শ্রম বিক্রির জন্য কোদাল-ডালি, করণী-বেলচা হাতে দাঁড়িয়ে ছিলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ক্রেতা না পেয়ে অনেকে দুপুরের মধ্যেই শুকনা মুখে বাড়ির পথ ধরেন। তাঁদের চোখেমুখে বাজারসদাই না নিয়ে ফেরার হতাশা।

শ্রমের হাটে দাঁড়িয়েই কথা হয় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বালুয়া থেকে আসা রাজমিস্ত্রি মোজাফফর হোসেনের (৬০) সঙ্গে। তিনি জানান, ১৬ বছর ধরে বগুড়া শহরে বাসাবাড়ি ও ভবন নির্মাণে কাজ করেন তিনি। দিনে তাঁর গড় উপার্জন ছিল ৮০০ থেকে ১ হাজার টাকা। এই উপার্জনেই সংসার চলত। ৩ হাজার টাকা ঘরভাড়ায় শহরের মাটিডালি এলাকায় স্ত্রী-সন্তান নিয়ে থাকেন। এর মধ্যে গ্রামের বাড়িতে ঘর তুলতে গিয়ে ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন একটা এনজিও থেকে।

মোজাফফর বলেন, ‘সারা দিনের উপার্জন থ্যাকে মাস শ্যাষে ৩ হাজার টেকা ঘরভাড়া আর ঋণের ১২ মাসের কিস্তির টেকা আলাদা করে পকেটত থুয়ে বাকি টেকায় চাল-ডাল, লবণ-পেঁয়াজ কিনে বাড়িত ফিরতে হয়। চার দিন ধরে কারফিউয়ে কাম বন্ধ। উপার্জনের চাকাও বন্ধ। ঘরত চাল-ডাল নাই। দুই দিন ধরে রান্নার চুলা জ্বলে না। মুড়ি-চিড়া খেয়ে কোনোরকমে বেঁচে আছি। রাত নামলে কিস্তি আর ঘরভাড়ার চিন্তায় চোখে ঘুম আসে না।’

শ্রমের হাটে কাজের খোঁজে আসা বগুড়া শহরতলির শাকপালা এলাকার আবদুল হামিদ বলেন, ‘চার দিন ধরে কামাই বন্ধ, ঘরত চাল-ডাল শ্যাষ। দুই দিন ধরে পরিবারে লিয়ে উপোস আচি। কারফিউ দিয়ে আর হামাগরক ঘরত আটকাবার কেউ পারবি না। ঘরত বউ-ছল লিয়ে না খ্যায়া মরার চেয়ে শহরত কাম করবার আসে গুলি খ্যায়া মরা অনেক ভালো। এই জন্যিই কামের খোঁজে এটি আসচি। কিন্তু বিয়ানবেলা থ্যাকে কামের জন্যি বসে আচি, কেউ কাম দিচ্চে না, খোঁজ লিচ্চে না।’

সাহেব আলীর বয়স ৭০ বছর ছুঁই ছুঁই। বাড়ি গাইবান্ধায়। ২৪ বছর ধরে তিনি পরিবারসহ বগুড়া শহরে আছেন। রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চলে। দিনে ৮০০ টাকা উপার্জন থেকে ঘরভাড়া ছাড়াও সংসারে ৭ সদস্যের অন্ন জোটাতে হয়। চার দিন ধরে সাহেব আলীও কারফিউয়ে ঘরবন্দী। উপার্জনও বন্ধ। অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটছে তাঁর পরিবারের। সাহেব আলী বলেন, ‘চার দিন ধরে শহরত কারফিউ। তারও আগে তিন দিন ধরে শহরত যুদ্ধাবস্থা। টানা সাত দিন ধরে শহরডা প্রায় অচল। কাম নাই, কামাই-রোজগারও নাই। দ্যাশের অবস্থা এখন ভয়ংকর। করোনাকালেও না খ্যায়া মরা লাগেনি। অনেকেই চাল-ডালসহ ঘরত খাবার পৌঁছে দিচে। এইবার তো সরকারই দ্যাশ সামলাবার পারিচ্চে না, হামাকেরে খোঁজ লিবি কেডা?’