ভয়াবহ জঙ্গি হামলার শিকার গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারি | ফাইল ছবি 

মাহমুদুল হাসান: দেশে এখন পর্যন্ত যত জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোতে মূলত চারটি সংগঠনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। এদের মধ্যে তিনটি সংগঠন একেবারেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। কারও কারও নামমাত্র কার্যক্রম রয়েছে। তবে এখনো তৎপর আছে আনসার আল–ইসলাম বাংলাদেশ।

জঙ্গিবাদ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, অন্য জঙ্গি সংগঠনগুলোর নড়বড়ে সাংগঠনিক কাঠামোর সুযোগ নিয়ে আনসার আল–ইসলাম নানা পর্যায়ে আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছে। দেশের প্রায় সব এলাকায় ‘সেল’ গঠন করে চলছে কার্যক্রম। তারা নতুন সদস্য সংগ্রহের পাশাপাশি পাঁচ–সাত বছরের পরীক্ষিত সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এই গোষ্ঠীটিকে এখন দেশে জঙ্গিবাদের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, রাজধানীর হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার আট বছর পর অনেকটাই স্তিমিত হয়েছে জঙ্গিদের তৎপরতা। ২০১৬ সালের ১ জুলাই ওই হামলায় ২২ জন নিহত হয়েছিলেন। এই হামলা করেছিল আইএস (ইসলামিক স্টেট) মতাদর্শী জঙ্গিগোষ্ঠী নব্য জেএমবি। এই হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ১৫টি অভিযানে সংগঠনটির ৬৪ জন সদস্য নিহত হন। এর বাইরে শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের বেশির ভাগই গ্রেপ্তার হন। এতে তাদের সাংগঠনিক কাঠামো ভেঙে যায়। তা ছাড়া সিরিয়া-ইরাকসহ বিশ্বজুড়ে জঙ্গি সংগঠন আইএসের পতনের পর বাংলাদেশেও তাদের অনুসারী এই গোষ্ঠীটির তৎপরতা কমেছে।

দেশে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি ও বর্তমানে তাঁদের তৎপরতা নিয়ে গত শনিবার কথা হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের প্রধান মো. আসাদুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি বলেন, দেশে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি এখনো আছে। যে চারটি সংগঠন আগে খুব বেশি সক্রিয় ছিল, যারা বিভিন্ন সময় দেশে নাশকতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়েছে, তাদের মধ্যে জামাআতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), নব্য জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ আল-ইসলামী বাংলাদেশের (হুজিবি) তুলনায় আনসার আল–ইসলামের তৎপরতা এখন বেশি। এই সংগঠনই এখন ঝুঁকির জায়গা।

জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা পুলিশের এই ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আরও বলেন, জঙ্গিদের দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকলেও সাইবার স্পেসে তারা সক্রিয় আছে। ধীরগতিতে হলেও তাদের সদস্য সংগ্রহ অব্যাহত আছে। এটাই এখন আমাদের বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও তাদের বড় হামলা করার সক্ষমতা এখন আর নেই। সামগ্রিকভাবে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে আছে।

দুশ্চিন্তার কারণ আনসার আল–ইসলাম
আনসার আল–ইসলাম ২০১৩ সালের দিকে আলোচনায় আসে। ওই সময় ব্লগার অভিজিৎ রায়, আহমেদ রাজিব হায়দারসহ লেখক ও বিভিন্ন অধিকারকর্মীর ওপর বেশ কয়েকটি হামলা চালান সংগঠনটির সদস্যরা। তখন বড় ধরনের সহিংস কর্মকাণ্ডে না জড়িয়ে ‘সফট টার্গেট’ হিসেবে এমন ১৩টি হামলার ঘটনা ঘটান তাঁরা।

২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল আনসার আল–ইসলামের সদস্যরা সর্বশেষ রাজধানীর কলাবাগানের বাসায় ঢুকে সমকামী অধিকারকর্মী জুলহাজ মান্নান ও তাঁর বন্ধু থিয়েটারকর্মী মাহবুব রাব্বী তনয়কে কুপিয়ে হত্যা করেন। এরপর ২০১৯ সালের ১১ জুন মুন্সিগঞ্জের প্রকাশক ও লেখক শাহজাহান বাচ্চু হত্যার ঘটনায় এই সংগঠনের নাম এলেও তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বিষয়টি স্বীকার করেনি। 

জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, মূলত ২০১৬ সালের পর থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনায় সংগঠনটি কঠোর গোপনীয়তা নীতি অনুসরণ করে। অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্যও তারা নিজেদের তৈরি অ্যাপস ব্যবহার করছে।

বিভিন্ন সময় আনসার আল–ইসলামের যেসব সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের থেকে এই জঙ্গি সংগঠনের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুটা ধারণা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সিটিটিসির কাছে তথ্য রয়েছে, আনসার আল–ইসলাম সারা দেশে তাদের কার্যক্রমকে বিভিন্ন ‘সেলে’ ভাগ করে পরিচালনা করছে। একটি সেলের প্রধানকে বলা হয় মাসুল বা দায়িত্বশীল। এই মাসুলদের ঊর্ধ্বতন ব্যক্তিকে বলা হয় মাজমা মাসুল। মাসুলরা তাদের কাজের বিষয়ে ঊর্ধ্বতনদের অবগত করে। তবে এ ক্ষেত্রে তারা প্রকৃত নাম ও পরিচয়ের পরিবর্তে ভিন্ন কোনো নাম ব্যবহার করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, আনসার আল–ইসলাম অনলাইনে এখন ১০০-১৫০টি ওয়েবসাইট পরিচালনা করছে। এগুলোতে নিয়মিত তাদের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। তা ছাড়া অনলাইনভিত্তিক যোগাযোগের মাধ্যম টেলিগ্রাম, ফেসবুক, এক্স ও ইনস্টাগ্রামেও তারা দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে।

দৃশ্যমান কর্মকাণ্ড না থাকার নেপথ্যে কী
বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রতিটি জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থানের সঙ্গে বৈশ্বিক জঙ্গিবাদের সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো মূলত আল-কায়েদা ও আইএস মতাদর্শ অনুসরণ করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক এসব সংগঠনের তৎপরতা এখন অনেকাংশে সীমিত হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তাদের অনুসারীদের কার্যক্রমও কমে গেছে।

এর বাইরে বিভিন্ন সময় জঙ্গি সংগঠনগুলো সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার মুখে তা থেমে গেছে। সর্বশেষ দুই বছর আগে হুজিবি ও পুরাতন জেমএবির কিছু সদস্য মিলে ‘জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া’ নামে নতুন একটি সংগঠন করে তৎপর হওয়ার চেষ্টা করে। সংগঠনটি পাহাড়ি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর আরেকটি নতুন সশস্ত্র সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের (কেএনএফ) শিবিরে প্রশিক্ষণ নেয়। পরে অভিযান চালিয়ে এই সংগঠনের ৮২ জনকে বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টানা অভিযানে হিন্দাল শারক্বীয়ার সাংগঠনিক কাঠামোও ভেঙে গেছে।

তবে জঙ্গিবাদ নির্মূলে কাজ করেন এমন ব্যক্তিরা বলছেন, দৃশ্যমান তৎপরতা না থাকার অর্থ এই নয় যে জঙ্গিবাদ নির্মূল হয়ে গেছে। এ জন্য সব সময় এ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। 

জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে কারা
জঙ্গিবাদে জড়িয়ে গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে সিটিটিসির এক গবেষণা বলছে, জঙ্গিদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই এমন সদস্য আছেন ১ দশমিক ৬ শতাংশ। মাদ্রাসায় পড়েছেন এমন সদস্য ২৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি সদস্য সাধারণ শিক্ষার। তাঁদের সংখ্যা ৭৩ দশমিক ২ শতাংশ। কারিগরি শিক্ষা পেয়েছেন এমন সদস্য ২ দশমিক ১ শতাংশ। জঙ্গিবাদে জড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সীদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি (৬৮ দশমিক ৭ শতাংশ)।

সিটিটিসি সূত্র বলছে, আনসার আল–ইসলাম বর্তমানে প্রযুক্তিতে পারদর্শীদের দলে ভেড়াতে বেশি তৎপর। এ জন্য তাদের ইদরাতুল দাওয়া নেটওয়ার্ক (আইডিএন) নামে আলাদা বিভাগও রয়েছে।

গবেষণাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান মনে করেন, অনেক দিন ধরে দেশে জঙ্গিদের আক্রমণ বা হামলার ঘটনা না ঘটলেও তাদের তৎপরতা ঠিকই আছে। তিনি বলেন, ‘জঙ্গি সংগঠনগুলো বিশেষ করে আনসার আল–ইসলামের জনবল সংগ্রহের প্রক্রিয়াও চলমান। নানা সময়ে তারা বিভিন্ন আস্তানা ও বিস্ফোরক রাখার স্থানেও যাচ্ছে। সাধারণত বড় কোনো হামলার প্রস্তুতিপর্ব দীর্ঘদিন ধরে চলমান থাকে। বিষয়টি বিবেচনায় রেখে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার।’

এই নিরাপত্তা বিশ্লেষকের মতে, উগ্র মতবাদ ছড়িয়ে পড়া থেকে জঙ্গিবাদের জন্ম নেয়। এই মতবাদ ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় আছে। এ দিকে আরও বেশি দৃষ্টি দেওয়া দরকার। তা ছাড়া ‘কাউন্টার রেডিকালাইজেশনের’ কৌশলগুলো প্রণয়নে আরও বেশি সক্রিয় হওয়া প্রয়োজন।