সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ বাজারের প্রধান সড়ক ডুবে যাওয়ায় নৌকায় চলাচল করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। গতকাল দুপুরে মধ্যবাজার এলাকায় | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
প্রতিনিধি সিলেট: সিলেটে কয়েক দিনের টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা ঢলে তৃতীয় দফার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত আছে। তবে পানিবন্দী মানুষের ভোগান্তি বেড়েছে। গতকাল বুধবার দুপুরের পর বৃষ্টি না হলেও সন্ধ্যা ও রাতে থেমে থেমে বৃষ্টি হয়েছে। জেলার ওপর দিয়ে বয়ে চলা সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর ছয়টি পয়েন্টে আজ বৃহস্পতিবারও বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, বন্যায় সিলেটের ১৩টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে; বিশেষ করে ভারত সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোয় দেশটির সঙ্গে যুক্ত নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে সিলেটের জকিগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট, জৈন্তাপুর ও কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ভারত থেকে নেমে আসা ঢলের পানি প্রথমেই আঘাত হানে। সীমান্তবর্তী উপজেলাগুলোর মধ্যে জকিগঞ্জ উপজেলায় কুশিয়ারা নদীর পানি বাঁধ উপচে ও বিভিন্ন স্থানে ভেঙে গিয়ে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
এদিকে কাল শুক্রবার পর্যন্ত সিলেট বিভাগে মাঝারি ধরনের ভারী থেকে অতি ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। বৃষ্টি অব্যাহত থাকলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্য অনুযায়ী, গতকাল সন্ধ্যা ছয়টার তুলনায় আজ সকালে সুরমা ও কুশিয়ারার সব কটি পয়েন্টে পানি বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সীমান্ত এলাকার নদ-নদীর পানি গতকালের তুলনায় আজ সকালে কমেছে। আজ সকাল ৮টায় সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ৭৪ সেন্টিমিটার, সিলেট পয়েন্টে ৮ সেন্টিমিটার, কুশিয়ারা নদীর অমলশিদ পয়েন্টে ১৫২ সেন্টিমিটার, শেওলা পয়েন্টে ৪৬ সেন্টিমিটার, ফেঞ্চুগঞ্জ পয়েন্টে ১০২ সেন্টিমিটার এবং শেরপুর পয়েন্টে ১৯ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল।
সিলেট নগরের শাহজালাল উপশহর এলাকার বিভিন্ন সড়কে পানি মাড়িয়ে চলাচল করছে বাসিন্দারা। আজ সকালে ডি-ব্লকে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
এদিকে নগরের ভেতরে বিভিন্ন এলাকা আজ সকাল পর্যন্ত জলাবদ্ধ অবস্থায় আছে। বাড়িঘর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় অনেক বাসিন্দা আশ্রয়কেন্দ্র অবস্থান করছেন। অনেকেই আবার ঠাঁই নিয়েছেন স্বজনদের বাড়িতে।
নগরের জামতলা এলাকার বাসিন্দা পীযূষ শীল বলেন, টানা বৃষ্টি হলেই মূল সড়কটি পানিতে ডুবে যায়। প্রতিবার সড়ক ডোবার সঙ্গে ঘরে ভেতরও পানি প্রবেশ করে। এক মাসের মধ্যে তাঁর ঘরে অন্তত ছয় দফায় পানি প্রবেশ করেছে। প্রতিবার পানি ঢোকার পর ঘরের মালামাল সরাতে গিয়ে একপ্রকার যুদ্ধ করতে হয়। সেই সঙ্গে জলাবদ্ধ ঘরের কারণে পরিবারের সদস্যদের অন্যত্র অবস্থানের ব্যবস্থা করতে হয়। এসব নিয়ে বেশ ভোগান্তি ও বিড়ম্বনার পড়েছেন।
পানি জমেছে ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকার বাসাবাড়ি ও প্রতিষ্ঠানে। গতকাল আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
বিয়ানীবাজারের ঘুঙ্গাদিয়া গ্রামের বাসিন্দা জসিম উদ্দিন জানান, কুশিয়ারা নদীর পানি উপচে তাঁদের গ্রামের ৮০ শতাংশ ঘর তলিয়ে গেছে। তৃতীয় দফার এ বন্যা গ্রামের প্রধান সড়কও ডুবিয়ে দিয়েছে।
কয়েক দিন আগেই পরিবারের আট সদস্য নিয়ে বন্যার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার নন্দীরগাঁও ইউনিয়নের মানাউরা গ্রামের বাসিন্দা এমাদ উদ্দিন। পানি কমে যাওয়ায় বাড়িও ফিরেছিলেন। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘর মেরামত করার আগেই আবার তৃতীয় দফায় বন্যা দেখা দিয়েছে। এমন অবস্থায় পরিবার নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তিনি। এমাদ বলেন, মানাউরা গ্রামের মূল সড়ক পানিতে তলিয়ে গেছে। বাসিন্দাদের মূল বাহন এখন নৌকা।
এদিকে ফেঞ্চুগঞ্জের বিয়ালীবাজর এলাকায় বাসিন্দা শোয়েব আহমদ বলেন, ঈদের তৃতীয় দিন তাঁর ঘরে পানি উঠেছিল। এরপর ঘিলাছড়া এলাকায় এক বন্ধুর খালি বাড়িতে আশ্রয় নেন। এবারও ১ জুলাই রাতে পানি বেড়ে যাওয়ায় একই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন।
ফেঞ্চুগঞ্জ সদরের হাসপাতাল রোডে ভোগান্তি নিয়ে চলছে লোকজন। গতকাল দুপুরে তোলা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ছবড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা ইয়াসিন আহমদ বলেন, গত মঙ্গলবার রাতে গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে যায়। এ সময় স্থানীয় বাসিন্দারা বস্তা ফেলে ডাইক মেরামত করেছিলেন। তবে সেটিও টেকেনি। গতকাল সকাল থেকে ডাইক ভেঙে গ্রামে পানি ঢুকছে। এতে আশপাশের আরও চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ বলেন, ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানি এখন নদীতে গিয়ে মিলছে। এ কারণে নদীর পানি বাড়লেও সীমান্তবর্তী নদ-নদীর পানি কমেছে। নদ-নদী পানিতে ভরা থাকায় নামতে বিলম্ব হচ্ছে।
সিলেট জেলা প্রশাসনের গতকাল জানায়, জেলার ১ হাজার ১৯২টি গ্রাম বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত জনসংখ্যা ৬ লাখ ৫৬ হাজার ৬৮৫। গতকাল পর্যন্ত জেলার ৬৪৬টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৮ হাজার ৯৫১ জন আশ্রয় নিয়েছেন।