জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন |
নিজস্ব প্রতিবেদক: দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকার অভিযান শুরু করেছে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, সে যে-ই হোক, দুর্নীতি করলে কারও রক্ষা নেই। যারাই দুর্নীতি করবে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
শনিবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সরকারের এমন অবস্থান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছি।’
সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান সরকারি কর্মকর্তার দুর্নীতির নানা অভিযোগ নিয়ে আলোচনার মধ্যেই সরকারপ্রধানের কাছ থেকে এমন বক্তব্য এল।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সংসদে তাঁর বক্তব্যে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখার বিষয়েও কথা বলেন। প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছে। এর পক্ষে-বিপক্ষে সংসদে ও সংসদের বাইরে নানা আলোচনা হচ্ছে। এই বিধান রাখার কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এটা কালোটাকা সাদা না। এখন সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। ঢাকায় যার এক কাঠা জমি আছে, সে কয়েক কোটি টাকার মালিক। এভাবে অনেক সময় কিছু করতে গিয়ে অতিরিক্ত অর্থ চলে আসে। সেটা তারা দেখাতে পারে না, আয়কর দিতে পারে না। আয়কর দিয়ে যাতে মূল জনগোষ্ঠীতে ফিরে আসে...এ ধরনের কর্মকাণ্ড যাতে না করে, সে জন্য মাঝেমধ্যে এ ধরনের সুযোগ দেওয়া হয়।’
সরকারপ্রধান বলেন, ‘এ ধরনের সুযোগ (কালোটাকা সাদা করা) খালেদা জিয়া নিয়েছিলেন, ড. কামাল হোসেন নিয়েছিলেন, আরও অনেকেই নিয়েছিলেন।...এমনকি বিএনপির সাইফুর রহমানও করেছেন। এরশাদ সাহেবও মনে হয় করেছেন…খোঁজ নিতে হবে। তিনি না করলেও কেউ না কেউ করেছে।’
এ সময় বিরোধীদলীয় নেতা জি এম কাদেরকে লক্ষ্য করে কিছুটা হাস্যরস করে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের বিরোধীদলীয় নেতা করছেন কি না, সেটা দেখতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যে সংসদকক্ষে হাসির রোল পড়ে।
‘সবকিছুতেই সমালোচনা’
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারের নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের প্রভাব দ্রুত বাজারে পড়বে বলে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ঋণের চাহিদা, অর্থের জোগান, ব্যাংক আর গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে সুদের হার নির্ধারণের পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব পদক্ষেপকে ফলপ্রসূ করতে সংকোচন নীতি অবলম্বন করা হয়েছে; যার প্রতিফলন এ বাজেটে রয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন কম গুরুত্বপূর্ণ খাতে ব্যয় কমিয়ে আনার লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এসব পদক্ষেপের কারণে আগামী অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি আরও নিয়ন্ত্রণে আসবে।
খেলাপি ঋণ নিয়ে সমালোচনার জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘দেশে কিছু আঁতেল আছেন, তাঁরা সবকিছুতেই সমালোচনা করেন। ঋণ খেলাপি নিয়ে অনেক কথা, মন্দ ঋণ নিয়ে অনেক কথা। ২০০৯ সালে জিডিপির আকার ছিল ১০২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (১০ হাজার ২০০ কোটি ডলার)। তখন ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ২২ হাজার কোটি টাকা। মন্দ ঋণ ছিল ১০ দশমিক ৫ শতাংশ। ২০২৩ সালে জিডিপির পরিমাণ ৪৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (৪৬ হাজার কোটি ডলার)। খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকা। সেখানে মন্দ ঋণের হার হচ্ছে ৯ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ এটা কিন্তু হ্রাস পেয়েছে।’
মানুষকে বিভ্রান্ত না করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, খেলাপি ঋণের কথা বলার সময় সব সময় টাকার অঙ্কে বলা হয়, শতাংশ বলা হয় না। এখানে শুভংকরের ফাঁকি দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।
‘বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি’
মেট্রোরেল নির্মাণের বিরোধিতাকারীদের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অনেকে বলেছিলেন ৩০ হাজার কোটি টাকা খরচ করে মেট্রোরেল না করলেই চলত। এটা অপচয়। তিন হাজার কোটি টাকা দিয়ে বাস কিনলেই তো যানজট মুক্ত হবে। এই হলো বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধি! এখন মেট্রোরেল মানুষের জীবন বিশেষ করে নারীদের জন্য সব থেকে নিরাপদে চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছে।
বিদ্যুৎ খাত নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘বিদ্যুৎ নিয়ে অনেক কথা। যে বিশেষ আইন করেছি, সেটা নিয়েও সমালোচনা শুনছি। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশেষ আইন যদি না করতাম, বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র নির্মাণ না করলে আজকে বিদ্যুৎটা আসত কোথা থেকে? আমরা ৩০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জন করেছি। ভবিষ্যতে বিদ্যুৎ যাতে পরিবেশবান্ধব হয়, আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিয়েছি। নেপাল ও ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানির উদ্যোগ নিয়েছি।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘গ্রামে লোডশেডিং যেন না দেওয়া হয়, তা বলে দিয়েছেন তিনি। গুলশান, বনানী, বারিধারা—এসব বড়লোকের এলাকায় ২ হাজার মেগাওয়াট লোডশেডিং দিয়ে তাদের মনে করিয়ে দিতে হবে এখন এয়ারকন্ডিশন (শীতাতপনিয়ন্ত্রণ যন্ত্র), গাড়ি, লিফট ইত্যাদি আরাম-আয়েশটা, এটা আসমান থেকে পড়েনি।’
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমাতে হবে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এ খাতে আমরা কেন ভর্তুকি দেব? বেশি বেশি এয়ারকন্ডিশন, ফ্রিজ, লিফট চলার জন্য দেব? তা তো দেব না। দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে যেটা করার দরকার, সেটা করব। যে যত বেশি ব্যবহার করবে, তাকে উৎপাদনের খরচটা অবশ্যই দিতে হবে।’
প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনা-সমালোচনার জন্য সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কেউ কেউ বাজেটকে উচ্চাভিলাষী বলেছেন। কেউ বলেছেন ঘাটতি বাজেট। তবে তিনি এই বাজেটকে মোটেই উচ্চাভিলাষী মনে করেন না।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘কখনো লক্ষ্য শতভাগ পূরণ হয় না। তারপরও সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য থাকে, এখানে যাব, সেখানে সরকার যেতে পেরেছে।’