নিজের চায়ের দোকানে কাজে ব্যস্ত সেলিনা খাতুন। গত সোমবার রাজশাহী নগরের মহানন্দা আবাসিক এলাকার বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি রাজশাহী: বাংলাদেশ থেকে এবার সবার আগে প্যারিস অলিম্পিকে খেলার সরাসরি টিকিট পেয়েছেন আর্চার সাগর ইসলাম (১৮)। সাগর ইসলামের এই কৃতিত্বে গর্বিত তাঁর মা সেলিনা খাতুন। অভাব-অনটনের মধ্যেও ছেলের স্বপ্নকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি।

তবে এই আনন্দের মধ্যেই রাজশাহী নগরে আয়ের একমাত্র উৎস চায়ের দোকান নিয়ে সেলিনা খাতুন দুশ্চিন্তায় রয়েছেন। নগরের মহানন্দা আবাসিক এলাকায় বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (আরডিএ) জায়গায় ওই দোকানের অবস্থান। কর্তৃপক্ষ সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালানোর উদ্যোগ নিয়েছে।

সেলিনা খাতুন জানান, স্বামী মারা যাওয়ার পর গত ১৫ বছর ওই চায়ের দোকানের আয়ে সংসার চালাচ্ছেন। দোকান না থাকলে তাঁদের আয়ের পথ থাকবে না; পথে বসতে হবে। পুনর্বাসন না করে তিনি দোকান উচ্ছেদ না করার দাবি জানান।

সেলিনা খাতুনের চার সন্তান। দুই ছেলের মধ্যে সাগর ইসলাম ছোট; জাতীয় দলের আর্চার। বড় ছেলে ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতকে (অনার্স) পড়ছেন। দুই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন। চায়ের দোকানের আয়ে চার ছেলেমেয়েকে বড় করেছেন তিনি। চায়ের সঙ্গে বিস্কুট, কলা ও সিগারেট বিক্রি করা হয়। গত সোমবার ওই দোকানে বসে সেলিনা খাতুনের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘সাগর যখন ছোট, তখন দোকানের টুলের ওপরে শোয়ায়ে রাখতেন। যখন খুব মশা লাগত, তখন গায়ের ওপরে কাপড় দিয়ে রাখতেন। ভোর ৫টায় দোকানে আসতেন; আর রাত ১১টায় বাড়ি ফিরতেন। এভাবেই কষ্ট করে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছেন।’  

সাগর ইসলাম ২০১৭ সালে রাজশাহী ‘এসবি আর্চারি ক্লাবে’ ভর্তি হয়ে অনুশীলন শুরু করেন। দুই বছর পর ২০১৯ সালে তিনি ভর্তি হন বিকেএসপিতে। বিকেএসপিতে ভালো করে জাতীয় দলে সুযোগ পান। ১৭ জুন তুরস্কের আনাতোলিয়ায় ‘২০২৪ ফাইনাল ওয়ার্ল্ড কোটা টুর্নামেন্ট’-এ ছেলেদের রিকার্ভ এককে দারুণ পারফর্ম করে অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেন সাগর। প্যারিস অলিম্পিকের আগে সেটিই ছিল রিকার্ভ ইভেন্টে সরাসরি যোগ্যতা অর্জনের শেষ সুযোগ। সেমিফাইনালে উঠে অলিম্পিকে খেলা নিশ্চিত করে সেখানেই থেমে যাননি সাগর। ফাইনালে উঠে শেষ পর্যন্ত জিতেছেন রুপা।

গত মঙ্গলবার সাগর ইসলাম দেশে ফেরেন। এখন টঙ্গীতে জাতীয় দলের ক্যাম্পে রয়েছেন। সাগর মুঠোফোনে বলেন, ‘এই চায়ের দোকান চালিয়েই মা আমাদের মানুষ করেছেন। এখানেই আমরা বড় হয়েছি। এখন অন্য কোথাও পুনর্বাসন করা হলে আমরা কিন্তু দাঁড়াতে পারব না। আমার দাবি, আমার মায়ের চায়ের দোকানটা যেন ওখানেই চালাতে দেওয়া হয়।’

সোমবার রাজশাহী নগরের মহানন্দা আবাসিক এলাকায় বঙ্গবন্ধু কলেজ মোড়ে সেলিনা খাতুনের দোকানে কথা হয় এসবি আর্চারি ক্লাবের সভাপতি ও কোচ সাইফুদ্দিনের (বাচ্চু) সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘রাজশাহী বিভাগ থেকে এই প্রথম কোনো খেলোয়াড় (সাগর ইসলাম) অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হলেন। এটি রাজশাহীর জন্য একটি বিরাট গর্বের ব্যাপার। যে ছেলে দেশের জন্য এত বড় সম্মান বয়ে আনছেন, তাঁর পরিবারের পাশে প্রশাসনের দাঁড়ানো দরকার। হয়তো সাগরের মায়ের দোকানটা রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের জায়গায় রয়েছে। কিন্তু ছেলের অর্জনের দিকে তারা পরিবারের জন্য জায়গাটা ছেড়ে দিতে পারে।’

রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের এস্টেট অফিসার বদরুজ্জামান বলেন, বছরে চারবার তাঁরা উচ্ছেদ অভিযান চালান। তাঁদের প্লটে অবৈধভাবে কেউ দোকান করলে, তাঁকে উঠতেই হবে। তবে ওই চায়ের দোকানিকে তাঁরা উঠতে বলেননি। হয়তো প্লটের মালিক আরডিএর কথা বলে তাঁকে সরে যেতে বলেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে বদরুজ্জামান বলেন, আরডিএর প্লটে কাউকে পুনর্বাসন করার সুযোগ নেই, নীতিমালাও নেই। জেলা প্রশাসক চাইলে ভূমিহীনকে কোনো খাসজমি বরাদ্দ দিতে পারেন।

এ বিষয়ে জানতে জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও তিনি ফোন ধরেননি। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) কল্যাণ চৌধুরী জানান, বিষয়টি তিনি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে জানাবেন।