গবেষণার জন্য পরীক্ষাগারে একটি প্লাস্টিকের বাক্সে রাখা হয়েছে ইঁদুর | ছবি: রয়টার্স ফাইল ছবি
পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষায় নমুনা হিসেবে প্রাণী ব্যবহারের বিরুদ্ধে আপত্তি জানিয়ে থাকেন প্রাণীপ্রেমীরা। এমনকি পরীক্ষাগারের টেকনিশিয়ানদের মধ্যেও এ নিয়ে অস্বস্তি দেখা যায়। অথচ মানুষের শরীরে কোনো ওষুধ বা অন্য কোনো উপকরণের ব্যবহার নিরাপদ হবে কি না, সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে প্রাণীকে নমুনা হিসেবে বেছে নেওয়া হয়।
গবেষকদের দীর্ঘদিনের চাওয়া, গবেষণার ক্ষেত্রে প্রাণীর বদলে যেন অন্য কিছু ব্যবহার করা হয়। এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) পদ্ধতি কাজটিকে ত্বরান্বিত করছে।
বিজ্ঞানীরা দাবি করছেন, গবেষণায় প্রাণীর বদলে অন্য কিছু ব্যবহারের সম্ভাবনার ক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি বেশ কার্যকারিতা দেখাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন সময় প্রাণীদের ওপর চালানো পরীক্ষাগুলোর তথ্য এক জায়গায় জড়ো করে সেগুলোর ব্যাপারে এআই ব্যবস্থাকে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়। এতে অহেতুক আর নতুন পরীক্ষা চালানোর প্রয়োজন পড়বে না।
যুক্তরাষ্ট্রের অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ফিজিশিয়ানস কমিটি অব রেসপনসিবল মেডিসিনের জ্যেষ্ঠ গবেষণা বিশ্লেষক জোসেফ মানুপপেলো মনে করেন, এ প্রযুক্তি কাজে দেবে। কারণ, কয়েক দশকের তথ্য এক জায়গায় জড়ো করে যথাযথভাবে বিশ্লেষণ করার কাজটি বিজ্ঞানীদের জন্য কঠিন।
জোসেফ মানুপপেলো বলেন, ‘চ্যাটজিপিটির মতো এআই মডেলগুলোর অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার করে এসব তথ্য সংগ্রহ ও এক জায়গায় জড়ো করা এবং এর সর্বোচ্চ ব্যবহার করা নিয়ে আমি খুব আশাবাদী।’
যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের টক্সিকোলজির অধ্যাপক টমাস হারটাং ‘সেন্টার ফর অলটারনেটিভস টু অ্যানিমেল টেস্টিং’-এর পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, এআই মানুষের মতো কিংবা তার চেয়ে বেশি ভালোভাবে বৈজ্ঞানিক কাগজপত্র থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
হারটাং বলেন, বর্তমানে যেসব কারণে প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়, তার একটি হলো নতুন রাসায়নিকের নিরাপত্তা যাচাই। যেহেতু প্রতিবছর বাজারে এক হাজারের বেশি এমন নতুন উপকরণ ঢুকছে, সে ক্ষেত্রে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হবে। তাঁর দাবি, ইতিমধ্যে প্রশিক্ষিত এআই ব্যবস্থা ব্যবহার করে একটি নতুন রাসায়নিকের বিষক্রিয়ার মাত্রা নির্ণয় শুরু হয়েছে।
অধ্যাপক হারটাং মনে করেন, টক্সিকোলজিতে অনেক দিন ধরেই সফটওয়্যার ব্যবস্থা ব্যবহার করা হলেও এআই ব্যবহারের মধ্য দিয়ে নির্ভুলতার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, এটি হঠাৎই সুযোগ তৈরি করেছে, যা আগে ছিল না। এআই এখন বিষক্রিয়া পরীক্ষার প্রতিটি পর্যায়ে যুক্ত। এমনকি নতুন ওষুধ তৈরির প্রথম পর্যায়েও এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে।
তবে রাসায়নিকের নিরাপত্তা নির্ধারণে এআই পদ্ধতিকে একেবারে নিখুঁত বলা যায় না। তথ্যের ভিত্তি প্রবণতা নির্ধারণের ক্ষেত্রে সমস্যা আছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একটি জাতিগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসংক্রান্ত তথ্য ব্যবহার করে এআই তৈরি করা হলে অন্য জাতিগোষ্ঠীর ক্ষেত্রে সেটি পুরোপুরি যথাযথ তথ্য না-ও দিতে পারে।
অধ্যাপক হারটাং বলেন, প্রাণীর ওপর মানুষের ওষুধের পরীক্ষামূলক প্রয়োগে যে ফল পাওয়া যায়, তা সব সময় কার্যকর না-ও হতে পারে। উদাহরণ হিসেবে আর্থ্রাইটিসের একটি ওষুধের কথা উল্লেখ করেন তিনি।
প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে পাওয়া ফলাফলের ভিত্তিতে আর্থ্রাইটিসের ভিওক্স ওষুধ অনুমোদন পেয়েছিল ও বাজারজাত করা হয়েছিল। তবে পরে গবেষণায় দেখা যায়, দীর্ঘ সময় ধরে এ ওষুধ ব্যবহার করলে মানুষের হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
আবার এমনও দেখা গেছে যে প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালিয়ে অকার্যকর হওয়া অনেক ওষুধ মানুষের শরীরে কার্যকর হয়েছে। যেমন ব্যথানাশক অ্যাসপিরিন মানুষের জন্য কার্যকর হলেও ইঁদুরের ভ্রূণের জন্য তা বিষাক্ত বলে প্রমাণিত হয়।
অধ্যাপক হারটাং আরও বলেন, ইতিমধ্যে কয়েকটি ক্ষেত্রে প্রাণীর ওপর পরীক্ষার চেয়ে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বেশি যথার্থ ফলাফল পাওয়া গেছে।
ভবিষ্যতে যেন প্রাণীর ওপর পরীক্ষার বদলে এআই ব্যবহার করা যায় তা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের ওষুধ প্রশাসন একটি এআই প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অ্যানিমেলজিএএন নামের এ সফটওয়্যার ব্যবহার করে যথার্থভাবে জানা যাবে যে নতুন রাসায়নিক ব্যবহার করলে ইঁদুরের প্রতিক্রিয়া কেমন হবে।
ইঁদুরের ওপর চালানো ১ হাজার ৩১৭টি পরীক্ষার ৬ হাজার ৪৪২টি তথ্য ব্যবহার করে এআই সফটওয়্যারটি তৈরি করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একই ধরনের আরেকটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এটির নাম ভার্চ্যুয়াল সেকেন্ড স্পেসিস। এর আওতায় এআই পরিচালিত একটি ভার্চ্যুয়াল কুকুর ব্যবহার করা হবে। এটিকে বিভিন্ন সময়ে কুকুরের ওপর পরিচালিত পরীক্ষাগুলোর তথ্য দিয়ে প্রশিক্ষিত করা হচ্ছে।
জার্মান ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি মায়ের্কের প্রধান ভেটেরেনারি কর্মকর্তা কারস্টিন ক্লেইনস্মিত-ডর বলেন, প্রাণীর ওপর পরীক্ষা চালানোর বিষয়টি রাতারাতি বাদ দেওয়া যাবে না। যৌক্তিক কারণে প্রাণীদের ওপর পরীক্ষা চালানো জরুরি হয়ে পড়ে ও অনেক ক্ষেত্রে তা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
ভার্চ্যুয়াল সেকেন্ড স্পেসিস নামক এআই প্রকল্পে ডরের প্রতিষ্ঠানও পৃষ্ঠপোষকতা করছে। তাঁর আশা, ভবিষ্যতে এখনকার চেয়ে অপেক্ষাকৃত ভালো ধরনের প্রাণীবিহীন পরীক্ষা পদ্ধতি ব্যবহার করে অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধান করা যাবে।