সংসদে আলোচনা: বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কেন হবে

মাহবুব উল আলম হানিফ ও মোতাহার হোসেন | ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক: সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতি নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ক্ষমতাসীন দলের দুজন সংসদ সদস্য (এমপি)। তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেছেন, সরকারি কর্মচারীদের দফায় দফায় বেতন বাড়ানোর পরও দুর্নীতি কেন হবে? চাকরিতে যোগ দেওয়ার সময় এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর সরকারি কর্মচারীদের হলফনামা আকারে সম্পদের হিসাব দাখিলের বিধান করার দাবি জানান।

একই সঙ্গে সরকারি কর্মচারীরা যাতে দুর্নীতিতে না জড়ান, সে জন্য আইন আরও কঠোর করতে পরামর্শ দিয়েছেন হানিফ। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের আরেক সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন অভিযোগ করেন, সরকারি কর্মকর্তারা দেশে–বিদেশে বাড়ি–গাড়ি করেন। সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন। কিন্তু দোষ হয় রাজনীতিবিদদের।

দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি 

মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, দুর্নীতি সরকারের সব অর্জন ম্লান করে দিচ্ছে। সরকার বারবার দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ (শূন্য সহিষ্ণুতা) নীতি ঘোষণা করেছে। তারপরও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। দুর্নীতির বিধিবিধানকে বরং আরও নমনীয় ও শিথিল করে দেওয়া হয়েছে। নামমাত্র দণ্ড দিয়ে তাঁদের চাকরিতে বহাল রাখার সুযোগ রাখা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, আজকে দুর্নীতির কথা উঠলে সবাই প্রথমে আঙুল দেখায় রাজনীতিবিদদের দিকে। রাজনীতিবিদেরা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত, এটা দেশে প্রচলিত আছে। অথচ সংসদ সদস্যদের মধ্যে মন্ত্রী ছাড়া কারও নির্বাহী ক্ষমতা নেই।
তাঁরা কীভাবে দুর্নীতি করবেন?

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কেনাকাটায় দুর্নীতি হয়, উল্লেখ করে মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, ‘সেখানে (উন্নয়ন ও কেনাকাটা) রাজনীতিবিদদের সুযোগ কোথায়, যদি সরকারি কর্মকর্তারা তার সঙ্গে জড়িত না থাকেন? ২০১৮ সালে জনপ্রশাসনে তথ্য এসেছিল, এক হাজার কর্মকর্তা–কর্মচারীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয়েছিল। এ রকম হাজার হাজার মতিউর (এনবিআরের সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমান) আছেন।’

মাহবুব উল আলম বলেন, এবার (ঈদুল আজহায়) একটি গরু ১ কোটি টাকা, একটি ছাগল ১৫ লাখ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যাদের অবৈধ আয় আছে, তারাই এই দামে কিনতে পারে। বৈধ আয়ে এটি সম্ভব নয়।

সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ নিয়ে আবার ভাবার পরামর্শ দিয়ে হানিফ বলেন, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা হলে তাঁদের গ্রেপ্তারে অনুমতি নেওয়া লাগে না। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে একই ধরনের মামলা হলে তাঁকে গ্রেপ্তারে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুমতি নিতে হয়। এই আইন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতি করতে উৎসাহিত করছে বলেও মনে করেন তিনি।

হানিফ বলেন, সরকারি চাকরিজীবীরা এক বছরের কম শাস্তি পেলে চাকরি থেকে অব্যাহতি পান না। সে ক্ষেত্রে তিরস্কার ও বিভাগীয় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে, যা সুশাসনের সহায়ক নয়। অথচ স্থানীয় প্রতিনিধিদের তাঁরাই তাৎক্ষণিক বরখাস্ত রাখার ক্ষমতা রাখেন। এই আইনের কারণে দুর্নীতি দমন কমিশন তাঁদের আইনের আওতায় আনতে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এটা কার্যত অপরাধী সুরক্ষা আইন হিসেবে বিবেচিত।

হানিফ বলেন, দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে প্রথমে ভোগের রাস্তা বন্ধ করতে হবে। গাড়ি ও স্বর্ণালংকারের দোকান থেকে তালিকা (যাঁরা কিনেছেন) নিয়ে বৈধ আয়ের উৎস জানতে চাওয়া হোক। একইভাবে জমি, বাড়ি বা অ্যাপার্টমেন্ট রেজিস্ট্রেশন যাঁরা করছেন, তাঁদের তালিকা নিয়ে আয়ের বৈধ উৎস জানার জন্য কৈফিয়ত চাওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে নিয়োগের সময় সম্পদের হলফনামা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রতি পাঁচ বছর পর বা পদোন্নতির সময় আবার হলফনামা জমা দেওয়ার বিধান চালু করার পরামর্শ দেন তিনি।

কালোটাকা সাদা করার সুযোগের পক্ষে
১৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩০ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখার পক্ষে মত দেন মাহবুব উল আলম। বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে একই ধরনের প্রস্তাব দেন আওয়ামী লীগের আরেক সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দীন।

সংসদ সদস্য মোতাহার হোসেন বলেন, ‘আজকে আমরা ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আছি। আমি ১৯৮৫ সালে যখন উপজেলা চেয়ারম্যান হই, তখন হাতীবান্ধায় ১০টি ইউনিয়ন ছিল। ১৯৮৭ সালে সার্ভে করে হিসাব করলাম ইউনিয়নগুলোর পাকা বাড়িগুলো কাদের। দেখলাম, ৯২ শতাংশ বাড়ি হচ্ছে সরকারি কর্মকর্তাদের।’

সরকারি দলের এই সদস্য বলেন, ‘এত বাড়ি, এত জমি, এত ঘরবাড়ি হলো, আমাদের এত ইন্টেলিজেন্স (গোয়েন্দা) কেউই টের পেল না। রক্ষক ভক্ষক হলে যা হয়, সেটাই হয়েছে। এদের হাতেই সবকিছু। আমাদের টিআর, কাবিখার বরাদ্দ দেওয়া হয়। এখন ডিসি সাহেবকে দেওয়া হয়। বিভাগীয় কমিশনারদের দেওয়া হয়। ইউএনওকেও দেওয়া হয়। আমরা কারা? আমাদের গুরুত্ব তো এভাবেই কমে যাচ্ছে।’

সরকারি কর্মকর্তারা দেশে–বিদেশে, বেগমপাড়ায় বাড়ি–গাড়ি করে বলেও অভিযোগ করেন মোতাহার হোসেন। তাঁর অভিযোগ, সরকারি কর্মকর্তারা সুইস ব্যাংকে টাকা রাখেন, দোষ হয় রাজনীতিকদের।

সাবেক প্রতিমন্ত্রী মোতাহার বলেন, ‘আমরা রাজনীতিবিদেরা আনক্ল্যাসিফাইড হয়ে যাচ্ছি।... আমরা তো পেছনে পড়ে গেছি। বরাদ্দের জন্য মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে গেলে বলেন সচিব সাহেবদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা তো মারাত্মক অবস্থায় পড়ে গেছি।’

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য একরামুজ্জামান বলেন, এর আগেও বাজেটে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ রাখা হয়েছিল, কিন্তু তাতে আশানুরূপ ফল দেখা যায়নি। তিনি শেয়ারবাজার ও শিল্পে কালোটাকা বিনিয়োগ করার সুযোগ দেওয়ার দাবি করেন।

জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম জিন্নাহ বলেন, ব্যাংক খাতে অন্যতম সমস্যা খেলাপি ঋণ। এখন এই ঋণ প্রায় তিন লাখ কোটি টাকা। এই টাকা পাচার হচ্ছে।