ইতালির পুলিয়াতে জি৭ সম্মেলনের এক ফাঁকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনসহ অন্য নেতারা। আজ শুক্রবার | ছবি: রয়টার্স |
পদ্মা ট্রিবিউন ডেস্ক: বিশ্বের উন্নত সাত দেশের সংগঠন জি৭-এর নেতারা সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন আজ শুক্রবার চীন নিয়ে আলোচনা শুরু করেছেন। বেইজিংয়ের সঙ্গে বাণিজ্য লড়াই এড়িয়ে কীভাবে তাঁদের শিল্পকারখানা রক্ষা করা যায়, সেদিকেই তাঁরা মূলত গুরুত্ব দিচ্ছেন।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিশেষ করে সবুজ প্রযুক্তি নিয়ে কীভাবে ন্যায্য ব্যবসা-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠা করা যায়, তা নিয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং জাপান, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, কানাডা ও যুক্তরাজ্যের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা আলোচনা করছেন।
ইতালির দক্ষিণাঞ্চলীয় পুলিয়া শহরে গতকাল বৃহস্পতিবার জি৭ সম্মেলন শুরু হয়েছে। আজ চলছে সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন।
আজ সম্মেলনে রাশিয়ার সামরিক সম্প্রসারণ নীতির প্রতি চীনের সমর্থন নিয়েও আলোচনা হচ্ছে। ওয়াশিংটনের অভিযোগ, রাশিয়ার প্রতি চীনের সমর্থন ইউক্রেন যুদ্ধকে আরও তীব্র করে তুলেছে।
জাপানের একটি সরকারি সূত্র জানায়, ‘চীনের বিরুদ্ধে জি৭ সদস্যভুক্ত দেশগুলো অভিন্ন নীতিতে রয়েছে।
উন্নত দেশগুলোর এই সম্মেলন এমন এক সময়ে হচ্ছে, যখন পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীনের বাণিজ্যিক সম্পর্কে একধরনের টানাপোড়েন চলছে। চলতি সপ্তাহে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চীনের তৈরি ইলেকট্রিক গাড়িতে নতুন করে শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও জি৭-এর অনানুষ্ঠানিক অষ্টম সদস্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) চীনের তথাকথিত ‘শিল্পায়নে অতিরিক্ত সামর্থ্য’ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
তারা বলছে, শিল্পায়নে বিশেষ করে সৌরবিদ্যুৎ ও ইলেকট্রিক গাড়ির মতো সবুজ জ্বালানি ও প্রযুক্তিতে বেইজিংয়ের উদার ভর্তুকির কারণে সে দেশের পণ্য অতিমাত্রায় সস্তা, যা ব্যাপকভাবে বিশ্ববাজার দখল করে নিয়েছে।
চীনের এই নীতির কারণে পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো, বিশেষ করে ক্রমবর্ধমান সবুজ শিল্পায়ন খাতে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জন কারবি সম্মেলন শুরুর আগে সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘আমরা চীনের অবাজারসুলভ নীতির মোকাবিলা করব। তাদের এই নীতি বিশ্ববাজারকে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত করছে।’
চীন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই ব্যাপারে চীনকে চাপ দিতে জি৭ সদস্যদেশগুলোর ঐক্যের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
জি৭-এর অর্থমন্ত্রীরা গত মাসে হুঁশিয়ার উচ্চারণ করে বলেন, তাঁরা সব দেশের জন্য ‘সমান ক্ষেত্র নিশ্চিত’ করতে জোরালো পদক্ষেপ নেবেন।
রপ্তানিতে বিধিনিষেধ
ইতালিতে জি৭ সম্মেলন শুরুর আগে চীনের তৈরি ইলেকট্রিক গাড়ির ওপর ৩৮ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এতে ইউরোপের বাজারে চীনের গাড়ি আমদানিতে বড় ধরনের হুমকি তৈরি হয়েছে।
বেইজিং ইইউর এই পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে বলেছে, এটা ‘নগ্ন সংরক্ষণবাদী আচরণ’। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) এ নিয়ে মামলার অধিকার রয়েছে চীনের।
ইতিমধ্যে গত সপ্তাহে চীনের তৈরি ইলেকট্রিক গাড়িতে ১০০ শতাংশসহ সবুজ প্রযুক্তির পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক অনেকটা বাড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এ সময় প্রেসিডেন্ট বাইডেন বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে ‘প্রতারণারও’ অভিযোগ এনেছেন।
আজকের বৈঠকে চীনে গ্যালিয়াম, জার্মেনিয়াম ও গ্রাফাইট রপ্তানির ওপর বিধিনিষেধ আরোপের ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে। টেলিযোগাযোগ ও ইলেকট্রিক গাড়ির শিল্পে এই খনিজ পদার্থ খুবই দরকারি।
চীনের ওপর এসব বিধিনিষেধ সে দেশে আন্তর্জাতিক সরবরাহব্যবস্থাকে ব্যাপক ঝুঁকির মধ্যে ফেলতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, ভবিষ্যতে চীনের ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনে জরুরি এমন আরও অনেক পণ্যের কাঁচামালের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করা হতে পারে।
বিশ্লেষকেরা সতর্ক করে বলেন, চীনের বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হলে অদূর ভবিষ্যতে সরবরাহব্যবস্থায় ঘাটতি দেখা দেবে, এতে বিশ্ববাজারে অনেক পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। কারণ, পশ্চিমা বিশ্ব নানা পদক্ষেপ নিলে চীনও বসে থাকবে না। তারাও পাল্টা ব্যবস্থা নেবে।
রাশিয়ার যুদ্ধ মেশিন
নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা–সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় নিয়েও সম্মেলনে আলোচনা হচ্ছে। বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীকে সহায়তার অভিযোগ আনা হয়েছে।
গতকাল ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে এক সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, রাশিয়ায় প্রয়োজনীয় ‘যুদ্ধ সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতি’ সরবরাহে চীনের ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির বিরুদ্ধে সম্মিলিত ব্যবস্থা নিতে জি৭ সদস্যভুক্ত দেশগুলো একমত হয়েছে।
ওয়াশিংটন অভিযোগ তুলেছে, বেইজিং রাশিয়ার প্রতিরক্ষা শিল্পকে সহায়তা করছে। আর সেই শিল্পে তৈরি অস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনে হামলা চালাচ্ছে রাশিয়া। যৌথভাবে দুই দেশ ড্রোন তৈরি করছে। এ ছাড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র তৈরির জন্য রাশিয়ায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রপ্তানি করছে চীন।
জেলেনস্কি বলেন, ‘আমি টেলিফোনে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি আমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, তিনি রাশিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রি করবেন না।’
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট বলেন, ‘আমরা বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করব।’
জি৭ নেতারা এশীয় প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা নিয়েও কথা বলেন। দক্ষিণ চীন সাগরের দ্বীপগুলোতে চীনের মুখোমুখি অবস্থান ও সামরিকায়ন এবং তাইওয়ানে তাদের যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা ওই অঞ্চলে সম্ভাব্য সংঘাতের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে।
সবশেষ জাপানে অনুষ্ঠিত জি৭-এর সম্মেলনে নেতারা তাঁদের চূড়ান্ত বিবৃতিতে বলেছিলেন, এই অঞ্চলে চীনের যেকোনো ধরনের সামরিক তৎপরতাকে তাঁরা প্রত্যাখ্যান করেন।
জাপান সরকারের সূত্র বলছে, ইতালির পুলিয়ার বৈঠকে চীনকে পরিষ্কার বার্তা দেওয়া দরকার যে এই বিষয় শুধু আঞ্চলিক নয়, জি৭-ভুক্ত সব সদস্য দেশের জন্যও উদ্বেগের।
সূত্র বলছে, জি৭-এর সব সদস্যদেশ এই ব্যাপারে সচেতন যে চীনের শীর্ষ পর্যায়ে বার্তাটি তাদেরকে খোলামেলাভাবে জানিয়ে দিতে হবে।