কারাগার | প্রতীকী ছবি |
প্রতিনিধি চাঁপাইনবাবগঞ্জ: প্রায় ১১ মাস ধরে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা কারাগারে হাজতবাস করছেন বৃদ্ধ স্বামী ও যুবক ছেলে। স্ত্রী গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউপির গ্রামের রাবিয়া বেগম আইনজীবীদের দ্বারে দ্বারে ঘুরেছেন, কিন্তু তাঁদের আইনি সহায়তার দিকে কেউ এগিয়ে আসেননি। কেননা স্বামী হাফিজ উদ্দীন (৬৮) ও ছেলে মারুফ ইসলামের (২৪) বিরুদ্ধে টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করা দুটি মামলার বাদী দুজন আইনজীবী। শুধু তা–ই নয়, ওই আইনজীবীদের বাবা হচ্ছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি)। ফলে কেউ ওই বাবা–ছেলের পক্ষে আইনজীবী হিসেবে কাজ করতে চায়নি বলে অভিযোগ রাবিয়া বেগমের।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাবা–ছেলের জন্য জেলা কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জেলা লিগ্যাল এইড কর্মকর্তার কাছে আইনজীবী নিয়োগের আবেদন জানানো হয়। সেই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে লিগ্যাল অফিস একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দেয়। কিন্তু সেই আইনজীবীও আসামিদের পক্ষে কাজ করতে রাজি জসসি। অন্যদিকে বাদীপক্ষ কারসাজি করে কারাগারের ভেতরে ওকালতনামায় টিপসই নিয়ে বাবা–ছেলের পক্ষে আশিক ইকবাল নামের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা আইনজীবী সমিতির এক সদস্যকে আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত করে। যাতে করে আশিক ইকবালের অনাপত্তিপত্র ছাড়া অন্য কোনো আইনজীবী বাবা–ছেলেকে আইনি সহায়তা দিতে না পারেন।
হাফিজ উদ্দীন ও তাঁর ছেলে মারুফ ইসলামে বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার বাদী আইনজীবী হওয়ায় তাঁদের আইনি সহায়তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করার বিষয়টি স্বীকার করেছেন জেলা লিগ্যাল এইড কার্যালয়ের নিয়োগ দেওয়া আইনজীবী আবু হাসিব।
স্বামী ও ছেলের জন্য তিনি আশিক ইকবালকে আইনজীবী নিযুক্ত করেননি দাবি করে রাবিয়া বেগম বলেন, ‘কারসাজি করে ওকালতনামা তৈরি করে তিনি (আশিক ইকবাল) আইনজীবী হয়েছেন আমার স্বামী ও ছেলের হাজতবাস দীর্ঘায়িত করার জন্য। ডাকযোগে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ এবং জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতির কাছে লিখিত আবেদন জানানো হয়েছে, যেন স্বামী ও ছেলের পক্ষে আইনি সহায়তা পাই। কিন্তু এরপরও কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি।’
বিভিন্ন অনলাইনে ‘বাদী আইনজীবী, তাই বাবা-ছেলে পাচ্ছেন না আইনজীবী’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশ হয়। বিষয়টি নিয়ে আদালত অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া হয়। এরপর বাবা–ছেলের জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জামিনের আবেদন জানান আশিক ইকবাল। ৬ মে আদালতে আবেদনের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আদালতের বিচারক জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করেন। এরপর রাবিয়া বেগম স্বামী ও ছেলের জন্য ঊর্ধ্বতন আদালতে যেতে মামলার নথিপত্র পাওয়া ও অন্য আইনজীবী নিয়োগের জন্য আশিক ইকবালের কাছে অনাপত্তিপত্র চেয়েও পাননি। ফলে বিনা বিচারে বাবা–ছেলে প্রায় ১১ মাস হাজতবাস করছেন।
আসামি হাফিজ উদ্দীন ও তাঁর ছেলে মারুফ ইসলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার চৌডালা ইউনিয়নের বিরামপাড়ার বাসিন্দা। তাঁরা ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা আত্মসাতের দুটি মামলার আসামি। এ মামলার প্রধান আসামি মো. আকবর হচ্ছেন হাফিজ উদ্দীনের জামাতা। আকবর সচ্ছল সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি লিমিটেড নামে একটি বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) তিন পরিচালকের একজন। এই সমিতিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জজ আদালতের পিপি নাজমুল আজমের স্ত্রী বেগম রোকেয়া ১ কোটি ৬৭ লাখ টাকা জমা রাখেন।
রাবিয়া বেগমের দাবি, যে এনজিও থেকে পিপি নাজমুল আজমের স্ত্রী বেগম রোকেয়ার টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে, সেই এনজিওর সঙ্গে তাঁর স্বামী হাফিজ উদ্দীনের কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি একজন নিরক্ষর দিনমজুর। তাঁদের ছেলে ওই এনজিওর একজন মাঠকর্মী মাত্র। আর জামাতা আকবর ওই এনজিওর তিন পরিচালকের একজন। পাওনা টাকার জন্য মীমাংসায় বসে আকবর আলী জমি লিখে দিয়েছেন। এরপরও পিপির দুই আইনজীবী ছেলের করা দুই মামলায় স্বামী ও সন্তান ২০২৩ সালের ৫ জুলাই থেকে হাজতবাস করে আসছেন।
রাবিয়া বলেন, ‘আমার স্বামী একজন বৃদ্ধ মানুষ। ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন। তিনি কারাগারে অনেক কষ্টে আছেন। পরিবারে উপার্জনক্ষম আর কোনো সদস্য উপস্থিত না থাকায় আমিও মানবেতর জীবন যাপন করছি। টাকা আত্মসাতের কোনো দায় আমার স্বামী ও ছেলের নেই। তবু তাঁরা মামলার আসামি হয়েছেন। শুধু তা–ই নয়, আমার এক মেয়ে ও প্রবাসে থাকা এক ছেলেকেও আসামি করা হয়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত এনজিওর অন্য পরিচালকের কোনো আত্মীয়কে আসামি করা হয়নি।’
লিখিতভাবে এসব বিষয় জানিয়ে রাবিয়া বেগম বার কাউন্সিলের সচিবের কাছে গত ২৩ মে আবেদন জানিয়েছেন। আবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইজীবী আশিক ইকবাল যেন তাঁর স্বামী ও ছেলের বিরুদ্ধে করা মামলার জাবেদা নকল তুলতে সহায়তা করেন এবং অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দিয়ে দেন, যাতে করে তিনি অন্য আইনজীবী নিযুক্ত করতে পারেন। আদালতে জামিনের আবেদন জানাতে পারেন।
রাবিয়া খাতুনের আবেদন পেয়েছেন জানিয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি সোলায়মান বিশু বলেন, মামলা বাদী আইনজীবী হলে বা আইনজীবীর বিপক্ষে কোনো আইনজীবী মামলা লড়তে পারবে না, এমন নিয়ম নেই। তবে কোনো মামলা গ্রহণ বা বর্জনের বিষয়টি আইনজীবীদের ব্যক্তিগত বিষয়।