ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের একটি ওয়ার্ড | ফাইল ছবি

শিশির মোড়ল: দেশের ৫৮ শতাংশ রোগীর ‘রেফারাল’ পদ্ধতি সম্পর্কে ধারণা নেই। ৫৯ শতাংশ রোগী নিজ উদ্যোগে উন্নত চিকিৎসার জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যান। অপর্যাপ্ত চিকিৎসা, জটিল রোগ, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতি—এসব কারণে রোগী হাসপাতাল পরিবর্তন করেন।

দেশে চিকিৎসা ক্ষেত্রে ‘রেফারাল’ পদ্ধতি কীভাবে কাজ করছে, তা নিয়ে এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। ১৬ জন গবেষক গবেষণাটি করেছেন। তাঁরা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউট, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বেসরকারি ডেলটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ট্রপিক্যাল ডিজিজ অ্যান্ড হেলথ রিসার্চ সেন্টার ও পিআই রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের গবেষক।

গবেষণা প্রবন্ধটি গত ২১ মে আন্তর্জাতিক প্রকাশনা সংস্থা স্প্রিঙ্গার নেচারের বিএমসি হেলথ সার্ভিসেস রিসার্চ সাময়িকীর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণার শিরোনাম ‘পেশেন্ট সেলফ-রেফারাল প্যাটার্নস ইন আ ডেভেলপিং কান্ট্রি: ক্যারেক্টারস্টিকস, প্রিভেলেন্স, অ্যান্ড প্রেডিক্টরস’।

উন্নত ব্যবস্থা গ্রহণ বা সিদ্ধান্তের জন্য রোগীকে এক চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে অন্য চিকিৎসাকেন্দ্রে পাঠানোর প্রাতিষ্ঠানিক পদ্ধতিই হচ্ছে ‘রেফারাল’। দক্ষতার সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া এবং বিশেষায়িত সেবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে দরকার কার্যকর ‘রেফারাল’ পদ্ধতি। সুষ্ঠুভাবে রোগী ব্যবস্থাপনা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য ‘রেফারাল’ পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। শুধু যার দরকার, সেই রোগীকেই এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। বিশ্বের অনেক দেশে এটি অনেকটা আইনের মতো। যে কেউ চাইলেই যেকোনো হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না।

সামন্ত লাল সেন বর্তমান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর একাধিক সভা-সেমিনারে বলেছেন, দেশের সব রোগীর ঢাকার বড় বড় হাসপাতালে আসার দরকার নেই। ঢাকার বা বিভাগীয় শহরের বড় হাসপাতালে রোগীর চাপ কমাতে হলে রেফারাল পদ্ধতি পুরোপুরি চালু করতে হবে।

গবেষণাটির অন্যতম গবেষক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের গ্লোবাল হেলথ ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌফিক জোয়ারদার বলেন, ‘রেফারাল পদ্ধতির সুবিধা ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কয়েক দশক ধরে আলোচনা হচ্ছে। কিন্তু এ নিয়ে কারও কাছে প্রমাণযোগ্য কোনো তথ্য নেই। তাই এই গবেষণা সেই তথ্যের ঘাটতি পূরণে সহায়তার পাশাপাশি নীতিনির্ধারণে ভূমিকা রাখবে।’

যেভাবে গবেষণা হয়েছে
গবেষকেরা ২ হাজার ৪০০ শয্যার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ৬২৬ জন রোগী এবং ৩৫০ শয্যার বেসরকারি ডেলটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ১৯৬ জন রোগীর ওপর গবেষণাটি করেছেন। এসব রোগী ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে এই দুই হাসপাতাল ভর্তি হয়েছিলেন।

মোট ৮২২ জন রোগী কীভাবে এবং কেন সর্বোচ্চ স্তরের (তৃতীয় স্তর) হাসপাতালে এলেন, তা দেখার চেষ্টা করেছেন গবেষকেরা।

হাসপাতাল দুটিতে আসার আগে সেবা পাওয়ার আরও কয়েকটি স্তর আছে। সেগুলো হলো স্যাটেলাইট ক্লিনিক, কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ কেন্দ্র, ইউনিয়ন সাবসেন্টার, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, জেলা হাসপাতাল বা জেলা সদর হাসপাতাল।

গবেষণার অন্তর্ভুক্ত রোগীদের গড় বয়স ছিল ৩৩ বছর। তাঁদের দুই-তৃতীয়াংশ পুরুষ, এক-তৃতীয়াংশ নারী। রোগীদের ৪৩ শতাংশ ছিলেন মধ্যবিত্ত, ২১ শতাংশ নিম্নবিত্ত, বাকি ৩৬ শতাংশ উচ্চবিত্ত পরিবারের।

গবেষকেরা যা দেখেছেন
গবেষণায় দেখা গেছে, ৪২ শতাংশ রোগী রেফারাল পদ্ধতি সম্পর্কে শুনেছেন। তাঁরা জানেন, তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক রেফারাল দরকার। ৫৮ শতাংশ রোগী জানেন না এই স্তরের হাসপাতালে ভর্তি হতে হলে এ ধরনের কোনো ব্যবস্থার দরকার হয়।

দুটি হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর ৪১ শতাংশকে অন্য কোনো হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে রেফার করা হয়েছিল। এর ১০ শতাংশ এসেছিলেন কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে। ইউনিয়ন সাবসেন্টার থেকে এসেছিলেন ৬ শতাংশ। ২৫ শতাংশ উপজেলা হাসপাতাল থেকে। জেলা হাসপাতাল থেকে এসেছিলেন ২২ শতাংশ। ২২ শতাংশ অন্য তৃতীয় স্তরের হাসপাতাল থেকে এসেছিলেন। আর ৪২ শতাংশ এসেছিলেন মালিকানাধীন ক্লিনিক থেকে।

গবেষণা অনুযায়ী, অন্য হাসপাতাল থেকে রেফার হওয়ার কারণ মূলত চারটি। চিকিৎসাব্যবস্থা নেই, পর্যাপ্ত চিকিৎসা নেই, জটিল রোগের চিকিৎসা নেই ও দক্ষ চিকিৎসকের ঘাটতি।

ঢাকা মেডিকেল ও ডেলটা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি রোগীদের ৫৯ শতাংশ এই দুই হাসপাতালে এসেছিলেন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রেফারাল ছাড়াই। এসব রোগীর ধারণা, প্রাথমিক স্তরের হাসপাতালে চিকিৎসার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেই, রোগনির্ণয়ের ব্যবস্থা দুর্বল।

উপসংহারে গবেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক রোগী প্রাতিষ্ঠানিক রেফারাল পদ্ধতিকে পাশ কাটিয়ে তৃতীয় স্তরের হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। এর অন্যতম কারণ, অধিকাংশ রোগী মনে করেন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ঘাটতি রয়েছে। এর জন্য তাঁরা দুটি সুপারিশ করেছেন। প্রথমত, একটি শক্তিশালী রেফারাল পদ্ধতি চালু করা। দ্বিতীয়ত, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর দক্ষতা বাড়ানো।

গবেষণাটিকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ আবু জামিল ফয়সাল। তিনি বলেন, একটি কার্যকর রেফারাল পদ্ধতি থাকলে উপজেলা হাসপাতাল থেকে জেলা হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল থেকে বিশেষায়িত হাসপাতাল—এভাবে রোগী আসত। কিন্তু এখন তা হয় না। কিছু রেফারাল হয়, এলোপাতাড়িভাবে। কিছু ক্ষেত্রে চিকিৎসকেরা দায়িত্ব এড়ানোর জন্য রেফার করেন। তাঁদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার ঘাটতি থাকে বলে রোগী অন্য হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন। এটা রেফারাল নয়। দরকার সঠিক রেফারাল পদ্ধতি, যার কথা গবেষকেরা বলেছেন।