বগুড়ায় ১০ বছরে ছয়টি ব্যাংকে ভল্ট ভেঙে লুট ও ডাকাতির চেষ্টা, কানাকড়িও উদ্ধার হয়নি

ডাকাতির ঘটনার পর তালাবদ্ধ বগুড়া সদরের মাটিডালি এলাকায় আইএফআইসি ব্যাংকের উপশাখা। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে | ছবি: পদ্মা ট্রিবিউন

প্রতিনিধি বগুড়া: বগুড়ায় গত এক দশকে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ভল্ট ভেঙে অর্থ লুট, হত্যা ও ডাকাতিচেষ্টার ছয়টি ঘটনা ঘটেছে। তবে পুলিশ লুট করা অর্থের কানাকড়িও উদ্ধার করতে পারেনি। হত্যাসহ অর্থ লুটের একটি ঘটনায় পুলিশ একজনকে গ্রেপ্তার করেছে। অন্য আরেকটি ডাকাতিচেষ্টার ঘটনায় একজন কিশোরকে ফাঁসানোর অভিযোগ আছে পুলিশের বিরুদ্ধে। বাকি চারটি লুট ও ডাকাতিচেষ্টার ঘটনায় কেউ শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হননি। একের পর এক লুট ও ডাকাতিচেষ্টার এসব ঘটনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের দুর্বল নিরাপত্তাব্যবস্থাকে দায়ী করেছে পুলিশ।

সর্বশেষ গত বুধবার গভীর রাতে বগুড়া শহরের মাটিডালি এলাকায় আইএফআইসি ব্যাংকের উপশাখার সিন্দুক ভেঙে ২৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা নিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় বৃহস্পতিবার রাতে আইএফআইসি ব্যাংকের বগুড়া শাখার কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে সদর থানায় মামলা করেছেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, ১২ জুন সারা দিনের লেনদেন কার্যক্রম শেষে বিকেলে আইএফআইসি ব্যাংকের মাটিডালি উপশাখার কর্মকর্তারা ২৯ লাখ ৪০ হাজার ৬১৮ টাকা ভল্টে রেখে তালাবদ্ধ করে কার্যালয় বন্ধ করে নিজ নিজ বাসায় চলে যান। বৃহস্পতিবার সকালে কার্যালয় খোলার পর ভল্ট ভাঙা দেখতে পেয়ে পুলিশকে খবর দেওয়া হয়। পরে দেখা যায়, সিন্দুকে গচ্ছিত সব টাকা চুরি হয়ে গেছে।

বগুড়া সদর থানার পরিদর্শক শাহীনুজ্জামান বলেন, আইএফআইসি ব্যাংকের মাটিডালি উপশাখায় ভল্ট ভেঙে ২৯ লাখ টাকা চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে। তবে এখনো অপরাধী শনাক্ত হয়নি। ভল্ট থেকে চুরি যাওয়া টাকাও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি।

২০১৪ সালের ৮ মার্চ এ রকমই ঘটনা ঘটে বগুড়ার আদমদীঘি উপজেলায় সোনালী ব্যাংকে। ওই দিন ব্যাংকটির ট্রেজারি শাখায় সুড়ঙ্গ খুঁড়ে ভল্ট ভেঙে ৩০ লাখ ৭৯ হাজার টাকা লুট করে দুর্বৃত্তরা। ওই ঘটনার ১০ বছর পার হলেও পুলিশ ওই টাকারও কানাকড়ি উদ্ধার করতে পারেনি। ওই ঘটনায় একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন এবং র‍্যাব-পুলিশসহ প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগ ওই সময় ব্যাপক তৎপরতা চালালেও ১০ বছরেও অপরাধী শনাক্ত হয়নি।

ভল্ট ভেঙে টাকা লুটের পরদিন বগুড়া সোনালী ব্যাংকের তৎকালীন উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) আবদুস সামাদ বাদী হয়ে আদমদীঘি থানায় মামলা করেন। নানা হাত ঘুরে সবশেষে মামলাটির  তদন্তভার যায় বগুড়া জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় (ডিবি)।

ভল্ট ভেঙে ৩০ লাখ টাকা লুটের পর ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রথম রাজশাহী বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (জিএম) এ টি এম আফজাল হোসেনকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। পরে ওই কমিটি বাতিল করে ব্যাংকের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মোস্তাফিজুর রহমানকে প্রধান করে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে এ ঘটনায় বাংলাদেশ ব্যাংকও একটি তদন্ত কমিটি করে। এ ঘটনায় প্রথমে আদমদীঘি শাখা সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপক শামসুদ্দিন শরীফ ও ক্যাশিয়ার আজহার আলীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। পরে বগুড়ার সোনালী ব্যাংকের ডিজিএম আবদুস সামাদকেও সাময়িক বহিষ্কার করে কর্তৃপক্ষ।

চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি রাতে এনআরবিসি ব্যাংকের বগুড়া সদর উপজেলার পল্লীমঙ্গল হাট উপশাখায় হানা দিয়ে দুর্বৃত্তরা ভল্ট ভেঙে ৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা লুটে করে। এ ঘটনায় মামলা হলেও জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার কিংবা শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের ভাষ্যমতে, বগুড়া সদরের পল্লীমঙ্গল এলাকার এনআরবিসি ব্যাংকের উপশাখায় দরজার তালা ভেঙে প্রবেশ করে দুর্বৃত্তরা। সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দুর্বৃত্তরা সিন্দুকে রাখা গ্রাহকদের আমানতের ৯ লাখ ৭৮ হাজার ৬১৪ টাকা লুট করে।

গত বছরের ২৩ এপ্রিল রাতে বগুড়ার প্রধান ডাকঘরে নৈশপ্রহরীর দায়িত্বে থাকা অফিস সহায়ক প্রশান্ত কুমার আচার্যকে হত্যা করে ভল্ট ভেঙে আট লাখ টাকা লুট করা হয়। ট্রেজারির ভল্টে ৪৩ লাখ ৭৭ হাজার টাকা রাখা ছিল। ঘটনার পরদিন প্রধান ডাকঘরের পোস্ট অফিস পরিদর্শক (শহর) মহিদুল ইসলাম বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় অজ্ঞাতনামা পাঁচ থেকে সাতজনকে আসামি করে হত্যা ও ডাকাতির মামলা করেন। ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে নওগাঁ থেকে শফিকুল ইসলাম (৪০) নামের এক ব্যক্তিকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তবে লুণ্ঠিত টাকা আজও উদ্ধার হয়নি।

চলতি বছরের ২৭ মে রাতে সোনালী ব্যাংকের শিবগঞ্জ সদর শাখায় ১০-১২ জনের ডাকাত দল নৈশপ্রহরী ও দুই আনসার সদস্যকে বেঁধে ভেতরে হানা দিয়ে ভল্ট ভেঙে টাকা লুটের চেষ্টা করে। এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত কিংবা গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। এ বিষয়ে শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল রউফ বলেন, সোনালী ব্যাংকে ডাকাতির চেষ্টায় জড়িত ব্যক্তিদের শনাক্ত করে তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।

২০২১ সালের ৪ জানুয়ারি রাতে রূপালী ব্যাংকের গাবতলী উপজেলার সাবেকপাড়া শাখায় ছুরিকাঘাত ও দাহ্য পদার্থ ছুড়ে দুই নিরাপত্তারক্ষী মাসুদ রানা (৩২) ও হাবিবুর রহমানকে (২৭) আহত করে ডাকাতির চেষ্টা হয়। মুখোশ পরা দুর্বৃত্ত প্রথমে ব্যাংকের প্রধান ফটক ও ছাদের দরজার তালা ভেঙে ফেলে। প্রধান ফটকের তালা ভেঙে ভেতরে ঢুকলে একজন নিরাপত্তারক্ষী আনসার সদস্য টের পেয়ে যান। তিনি অন্যজনকে ডেকে আনেন। নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে দুর্বৃত্তদের ধস্তাধস্তি হয়। একপর্যায়ে মাসুদ রানাকে ছুরিকাঘাত ও হাবিবুর রহমানকে অ্যাসিড–জাতীয় দাহ্য পদার্থ ছুড়ে হত্যার চেষ্টা চালানো হয়। দুর্বৃত্তরা ব্যাংকের ভেতরে ঢুকলেও ভল্ট ভাঙতে পারেনি, কোনো কিছু লুট করতে পারেনি।

পরদিন ব্যাংকের ব্যবস্থাপক বাদী হয়ে মামলা করেন। ঘটনার ১৮ দিন পর পুলিশ বগুড়ার নামী এক প্রতিষ্ঠানের এক কিশোর শিক্ষার্থীকে গাজীপুরের টঙ্গী থেকে গ্রেপ্তার করে। পরে পুলিশ সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, বিদ্যুৎ বিল দেওয়ার জন্য ব্যাংকে গিয়ে লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সঙ্গে ঝগড়ার প্রতিশোধ নিতে ওই কিশোর ব্যাংক লুটের পরিকল্পনা আঁটে। তবে সে সময় ওই কিশোরের বাবা তাঁর ছেলেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, পুলিশ তাঁর নিরীহ ছেলেকে গ্রেপ্তার করে ব্যাংক ডাকাতির ঘটনায় ফাঁসিয়েছে।

নিরাপত্তা নিয়ে উদাসীনতা
আদমদীঘি সোনালী ব্যাংকে লুটের ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি ব্যাংকে নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়ার সুপারিশ করলেও পুলিশ বলছে, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর অনেক শাখা-উপশাখায় নিরাপত্তাব্যবস্থা খুব দুর্বল।

বগুড়া সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সাইয়ান ওলিউল্লাহ বলেন, চলতি বছরের ২৬ জানুয়ারি রাতে এনআরবিসি ব্যাংকের বগুড়া সদর উপজেলার পল্লীমঙ্গল হাট উপশাখার ভল্ট থেকে ৯ লাখ ৭৮ হাজার টাকা চুরি যায়। ওই ব্যাংকে কোনো নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন না।

সর্বশেষ গত বুধবার রাতে আইএফআইসি ব্যাংকের মাটিডালি উপশাখার ভল্ট থেকে ২৯ লাখ টাকা চুরি গেলেও সেখানে ব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো নিরাপত্তা প্রহরী ছিলেন না। ২০২১ সালে কার্যক্রম শুরু হওয়ায় ব্যাংকটির উপশাখার কার্যক্রম চলত ভাড়া বাসায়। দোতলা ভবনের নিচতলায় মোটরসাইকেলের গ্যারেজ এবং ওপর তলায় ব্যাংকের কার্যক্রম চললেও রাতে সিঁড়িঘরের দরজা খোলা ছিল। দুর্বৃত্তরা ব্যাংকের সিঁড়িঘরের ইট সরিয়ে ব্যাংকে ঢুকে ভল্ট বা সিন্দুক ভেঙেছে।

বগুড়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. স্নিগ্ধ আখতার বলেন, ব্যাংকের প্রতিটি শাখা-উপশাখায় প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সেটা মানছে না।

জানতে চাইলে বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সংগঠন ব্যাংকার্স ক্লাব বগুড়া শাখার সাধারণ সম্পাদক শাহিনুর ইসলাম বলেন, একের পর এক কয়েকটি ব্যাংকে চুরি–ডাকাতি ও চুরি-ডাকাতির চেষ্টার ঘটনায় গ্রাহকেরা কিছুটা হলেও উদ্বিগ্ন। আইএফআইসি ব্যাংকের উপশাখা থেকে অর্থ চুরির ঘটনার পর ১৩ জুন ব্যাংকার্স ক্লাবের পক্ষ থেকে জেলার সব বাণিজ্যিক ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপকদের কাছে চিঠি পাঠিয়ে নিজ নিজ ব্যাংকের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে ঈদের ছুটিতে অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে প্রতিটি ব্যাংকের ভল্টে যতটা সম্ভব কম অর্থ গচ্ছিত রাখা ছাড়াও ব্যাংকের সার্বিক নিরাপত্তার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।